You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর প্রতীক মাহবুবুর রব সাদী

মাহবুবুর রব সাদী, বীর প্রতীক (১৯৪২-২০১৬) সাব- সেক্টর কমান্ডার ও মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সৈনিক। তিনি ১৯৪২ সালের ১০ই মে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলাধীন বনগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দেওয়ান মো. মামুন চৌধুরী ও মাতার নাম সৈয়দা জেবুন্নেছা খাতুন। ১৯৬১-৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং ১৯৬৩-৬৪ সালে মৌলভীবাজার কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। একই সময়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ- মৌলভীবাজার মহকুমা শাখার সভাপতি ও সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা রেডিও স্টেশনের একজন গায়ক ও গীতিকার ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে একজন সংগঠক হিসেবে মাহবুবুর রহমান সাদী স্থানীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এপ্রিল মাসে তিনি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৪নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তমএর অধীনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মেজর দত্ত সাদীর রাজনৈতিক পরিচিতি, দেশপ্রেম ও নেতৃত্বের গুণাবলি দেখে তাঁকে প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাতে তাঁর সফলতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে নবগঠিত জালালপুর সাব-সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দান করেন। উক্ত সাব-সেক্টর থেকে সফলতার সঙ্গে বহু যুদ্ধ পরিচালনা করে তিনি ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। কানাইঘাট থানা আক্রমণের সময় তিনি ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়েন, তবে ঘটনাক্রমে বেঁচে যান।
আগস্ট মাসে মাহবুবুর রব সাদী একদিন তাঁর অধীনস্থ ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কানাইঘাট থানা আক্রমণের জন্য রওনা হন। পাহাড়ি রাস্তা আর চা-বাগানের পথ ধরে হেঁটে তাঁরা রাত ৩টায় কানাইঘাটে পৌঁছান। থানায় তখন কিছু সংখ্যক পাকসেনাসহ ৩০-৪০ জন পুলিশ ও রাজাকার ছিল। থানার সামনে ২ জন পাহারারত সেন্ট্রি ছাড়া তখন সকলেই ঘুমাচ্ছিল। কমান্ডার সাদী নিজেই সেন্ট্রি ২ জনকে নিরস্ত্র করার জন্য সন্তর্পণে অগ্রসর হয়ে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে নিজের স্টেনগান তাদের বুকে ধরেন। কিন্তু এক সেন্ট্রি সঙ্গে-সঙ্গে তার রাইফেলের ট্রিগারে চাপ দেয়। গুলিটি সাদীর মাথার ঝাঁকরা চুল ভেদ করে চলে যায়। সঙ্গে-সঙ্গে থানার অভ্যন্তর থেকেও গুলি বর্ষিত হতে থাকে। বেগতিক দেখে থানার বাইরে অবস্থানরত সাদীর সহযোদ্ধারা আদেশের অপেক্ষা না করেই পাল্টা গুলি বর্ষণ শুরু করেন। দলনেতা সাদী তখন উভয় পক্ষের গুলির মধ্যে পড়ে যান। সাহসিকতা, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এ সঙ্কটময় অবস্থা থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। এরপর শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ। অনেক্ষণ গোলাগুলির পর টিকতে না পেড়ে শত্রুরা থানার পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যায়। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে ১৪টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতিস্বরূপ মাহবুবুর রব সাদী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন।
স্বাধীনতার পর মাহবুবুর রব সাদী প্রথমে সিলেট জেলা শান্তিরক্ষা বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২-৭৩ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে যোগদান করে তিনি জাতীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাসদের প্রার্থী হিসেবে নবীগঞ্জ-বাহুবল আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে জাসদের রাজনৈতিক মতবাদের সঙ্গে মতদ্বৈধতা দেখা দিলে তিনি রাজনীতি ত্যাগ করে বীমা ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত হন।
মাহবুবুর রব সাদী ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম তাজকেরা সাদী। ২০১৬ সালের ১৬ই অক্টোবর এ বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!