বীর উত্তম মাহবুবুর রহমান
মাহবুবুর রহমান, বীর উত্তম (১৯৪৪-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৪৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর দিনাজপুর শহরের দগাহবস্তি আবাসিক এলাকায় তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা অধ্যক্ষ মো. তছির উদ্দীন আহমেদ এবং মাতা জরিনা খাতুন। মাহবুবুর রহমান ১৯৬২ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৪ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের এবোটাবাদের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে সফলতার সঙ্গে কোর্স সমাপ্তির পর ১৯৬৯ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন এবং পদাতিক বাহিনীর ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের আজাদ কাশ্মীর রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স পাকিস্তানের খারিয়ান সেনানিবাস থেকে কুমিল্লা সেনানিবাসে স্থানান্তরিত হলে মাহবুবুর রহমানও কুমিল্লায় আসেন। ১৯৭০ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। তিনি ছিলেন অবিবাহিত।
স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। উত্তাল গণআন্দোলনের সময় তিনি সবে ছুটি কাটিয়ে ২৩শে মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে যোগদান করেন। তাঁর রেজিমেন্টের একজন পাঠান (যিনি তাঁকে পিতার মতো মনে করতেন) ক্যাপ্টেন মাহবুবুরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মিথ্যা বিয়ে করার কারণ দেখিয়ে পুনরায় ছুটি নিয়ে সেনানিবাস ত্যাগের পরামর্শ দেন। তিনি ছুটি নিয়ে ২৪শে মার্চ ঢাকা চলে আসেন। ২৫শে মার্চ থেকে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন। এ-সময় তিনি পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে মনস্থির করেন। তারপর পায়ে হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমএর ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বহু সফল অপারেশন, এম্বুশ ও সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং পাকবাহিনীকে দিশেহারা করে তোলেন। ১৬ই এপ্রিল তাঁর দল অসীম সাহসিকতার সঙ্গে কুমিল্লা থেকে লাকসামগামী পাকবাহিনীর ৩০টি গাড়ির কনভয়কে জাঙ্গালিয়া নামক স্থানে এম্বুশ করে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেন; হস্তগত করেন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও রশদ সামগ্রী। পরবর্তীতে তাঁরা পাকবাহিনীর নয়াদিঘি ক্যাম্প দখল করে নেন এবং বহু পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেন। পরে পাকবাহিনীর ব্যাপক বিমান ও আর্টিলারি হামলার মুখে ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান ও তাঁর দল সরে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অবস্থান নেয়। এ-সময় তিনি কিছুকাল আগরতলায় স্থাপিত প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এক নম্বর সেক্টরে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং পরে ‘জেড’ ফোর্সের আলফা কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে নিয়মিত বাহিনীর ‘জেড’ ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সীমান্ত এলাকা ছেড়ে সিলেট অভিমুখে অভিযান শুরু করে। ১৫ই নভেম্বর এ রেজিমেন্ট চারগ্রাম ও জকিগঞ্জ দখল করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা কানাইঘাটের দিকে অগ্রসর হন। উল্লেখ্য, এ- সময় পাকিস্তানি বাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল কানাইঘাট। সুতরাং কানাইঘাট দখল করা কৌশলগত কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তাঁরা সুরমা নদীর উভয় তীর দিয়ে অগ্রসর হয়ে নভেম্বরের চতুর্থ সপ্তাহে কানাইঘাটের দুই মাইল দূরত্বে গৌরীপুর পৌঁছান। সেখান থেকে তাঁরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল (আলফা ও ব্রাভো কোম্পানি) সুরমা নদীর উত্তর তীরে এবং অন্যদল (চার্লি ও ডেল্টা কোম্পানি) সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থান নেয়।
২৬শে নভেম্বর ভোরবেলা পাকিস্তানি বাহিনী তাদের কানাইঘাটস্থ বেজ ছেড়ে অগ্রসর হয়ে আকস্মিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করে। এর ফলে আলফা কোম্পানি (যার অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান) নাজুক অবস্থায় পড়ে। মাহবুবুর রহমান ও তাঁর সহযোদ্ধারা অত্যন্ত সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীকে পাল্টা আক্রমণ করতে থাকেন। কিন্তু প্রচণ্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনীর ছোড়া একটি কামানের গোলার আঘাতে তিনি শহীদ হন। এ-যুদ্ধে মাহবুবুর রহমানসহ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ২০ জন আহত হন। শত্রুপক্ষের একজন মেজর, একজন ক্যাপ্টেনসহ শতাধিক সৈন্য নিহত হয়। সিলেটের দীঘির খাঁ গ্রামে তাঁকে দাফন করা হয়। পরবর্তীতে ঐ গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘মাহবুব নগর’।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শহীদ ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমানকে ‘বীর উত্তম’ (মরণোত্তর) খেতাবে ভূষিত করা হয় (গেজেট নং ৩০, খেতাবের সনদ নং ২৩)। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ১৯৯৪ সালের ১১ই মে পার্বতীপুর থানার খোলাহাটিতে ‘বীর উত্তম শহীদ মাহবুবুর রহমান সেনানিবাস’ স্থাপন করা হয়। [সাজাহান মিয়া]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড