You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.23 | মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল) - সংগ্রামের নোটবুক

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল)

মামুদপুর গণহত্যা (গোপালপুর, টাঙ্গাইল) সংঘটিত হয় ২৩শে সেপ্টেম্বর। এতে ২৪ জন গ্রামবাসী শহীদ ও ৩০ জন আহত হন।
টাঙ্গাইল জেলা সদর থেকে গোপালপুর উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার এবং গোপালপুর সদর থেকে মামুদপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। গোপালপুর উপজেলার হাদিরা ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম মামুদপুর। এ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঘনিষ্ঠ সহচর, ১৯৭০ সালে নির্বাচিত এমএনএ হাতেম আলী তালুকদার। তিনি ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় ও বাইরের রাজাকার দের নিয়ে মামুদপুর এলাকায় অপারেশনে আসে। কাদেরিয়া বাহিনীর হনুমান কোম্পানি নামে খ্যাত কাজী আশরাফ হোসেন হুমায়ুন বাঙাল-এর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা তখন মামুদপুরের কাছে ভেঙ্গুলার কেরামজানী বাজারে অবস্থান করছিলেন। তাঁরা খবর পান যে, গোপালপুর থানা সদর থেকে প্রায় ৫০ জন পাকসেনা শতাধিক রাজাকার, আলবদর ও আলশামস নিয়ে নগদা শিমলা বাজার হয়ে মামুদপুর গ্রামের দিকে আসছে। তাদের অগ্রভাগে রয়েছে হাদিরা ইউনিয়নের চাতুটিয়ার কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার শফিউদ্দিন মুন্সী। সঙ্গে আছে নগদা শিমলা পলিশার রাজাকার খসরু, অশ্রু ও আবুল সরদার। মামুদপুরের দালালরাজাকারদের মধ্যে আইয়ুব আলী তালুকদার, আবদুল হাকিম তালুকদার, ইন্তাজ আলী তালুকদার, পার্শ্ববর্তী গ্রামের মহির উদ্দিন, আবদুল্লাহ প্রমুখ ঐদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তাদের দেখানো পথেই বর্বর ঘাতক বাহিনী নগদা শিমলা বাজার হয়ে আসার সময় রাস্তার আশপাশের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে- পুড়িয়ে মামুদপুর গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কোম্পানি কমান্ডার কাজী আশরাফ হোসেন হুমায়ুন বাঙাল তাঁর দল নিয়ে মামুদপুর পশ্চিমপাড়া বটগাছের সন্নিকটে রাস্তার পাশে অবস্থান নেন। অপর একটি দল পানকাতা স্কুলের পাশে। তৃতীয় দলটি মামুদপুর ও গনিপুরের মধ্যবর্তী স্থানে আক্রমণের জন্য পজিশন নিয়ে হানাদারদের অপেক্ষায় থাকে।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানি বর্বর হানাদাররা নগদা শিমলা গ্রামে কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়ে মামুদপুর গ্রামে পৌঁছে হাতেম আলী তালুকদার এমএনএ-র নতুন ও পুরাতন বাড়িতে আগুন দেয়। হাতেম আলী তালুকদারের বাড়ির আশেপাশে তাঁর নিজ বংশধরদের মধ্যে কামাল হোসেন তালুকদার, আজাহার আলী তালুকদার ও জুব্বার আলী তালুকদারের বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ, হত্যাযজ্ঞ ও লুটপাট করে। এ-সময় পাকিস্তানি ঘাতক ও রাজাকাররা হাতেম আলী তালুকদারের ছোটভাই হায়দার আলী তালুকদারসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে বিজয় উল্লাস করে। আশেপাশের আরো কিছু বাড়িঘরে আগুন দেয়, লুটপাট করে আর এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এই বিভীষিকাময় কাণ্ড দেখে অধিকাংশ গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে পালিয়ে যায়।
পাকিস্তানি হানাদারদের একটি গ্রুপ মামুদপুর থেকে পানকাতার দিকে এগিয়ে যায়। তাদের সঙ্গে ছিল কুখ্যাত রাজাকার শফিউদ্দিন মুন্সী। তারা গুটেংরা গোরস্থানের কাছে এসে সেখানে থেমে রাজাকার শফিউদ্দিন মুন্সীর পিতার কবর জিয়ারত করে আকাশে রাইফেলের গুলি ছুড়ে গানস্যালুট দেয়। আর তখনই পাকিস্তানি হানাদার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় দুঘণ্টা উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলা-বারুদ ফুড়িয়ে যায়। তখন তাঁরা পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। এ-যুদ্ধে আব্দুস ছোবহান তুলা, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী, বীর প্রতীক, আনোয়ার হোসেন খসরু, নান্নু প্রমুখ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে গ্রাম ও গ্রামের মানুষদের রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটলে ক্ষিপ্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মামুদপুর ও পানকাতা গ্রামে গণহত্যা শুরু করে। পথের মধ্যে তারা মামুদপুর গ্রামের ১০-১২ জন লোককে গুলি করে হত্যা করে। বাড়িবাড়ি গিয়ে আরো মানুষজন খুঁজতে থাকে। যাকে যেখানে পায় ধরে নিয়ে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন করে। কয়েকজন গ্রামবাসী পাশের আঙ্গুরা বিলের ধারে পালিয়েছিল। হানাদার ও রাজাকাররা সেখানে গিয়ে মামুদপুর গ্রামের পালিয়ে থাকা ১১ জন ও পানকাতা গ্রামের ২ জনকে ধরে ফেলে। তারপর পথের মধ্যে রাজাকার আবুল হোসেন সরদার ও খসরুর সহযোগিতায় মো. লুৎফর রহমান, আনোয়ার হোসেন আনু ওরফে গেদা, গুলমাজম এ তিনজন গরিব মানুষকে ধরে নিয়ে যায়। এদের পানকাতা মাদ্রাসার পূর্বে রাস্তার নিচে বসিয়ে গুলি করে। এতে মো. লুৎফর রহমান গুরুতরভাবে আহত হন। সেদিন পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনী মামুদপুর ও পানকাতা গ্রামে আরো ৩০-৩৫টি বাড়িতে আগুন দেয় এবং মালামাল লুটপাটসহ নারীনির্যাতন করে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করে।
এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তিনজন সৈন্য আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও গ্রামবাসীদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক গরু, ছাগল, ভেড়া মারা যায়। মামুদপুর গ্রামের ১৯ জন ও পানকাতা গ্রামের ৫ জন নারী-পুরুষ গণহত্যায় শহীদ হন। মারাত্মকভাবে আহত হন প্রায় ৩০ জন নারী-পুরুষ। মামুদপুর গ্রামে একটি গণকবর রয়েছে। এই গণকবরে ৪ জনের লাশ দাফন হয়। পানকাতা সামাজিক কবরস্থানে আরো ৪ জনকে দাফন করা হয়। অন্য যারা শহীদ হন তাদের কবর নিজ-নিজ বাড়িতে হয়।
মামুদপুর গণহত্যায় শহীদরা হলেন মো. আমজাদ আলী (পিতা আব্বাস আলী), খন্দকার আ. ওয়াদুদ মিয়া (পিতা আব্বাস আলী), মোসাম্মৎ রওশন আরা (পিতা হযরত আলী খন্দকার), মোসাম্মৎ বিমলা খাতুন (পিতা হযরত আলী খন্দকার), আবু তাহের (পিতা মোহাম্মদ আলী), মো. জামাল উদ্দিন (পিতা আলীম উদ্দিন), ময়না মিয়া (পিতা মোশারফ হোসেন), আনোয়ার হোসেন আনু (পিতা মোশারফ হোসেন), গোলম আজম (পিতা আহেদ আলী), আমীর আলী (পিতা আহেদ আলী), মকবুল হোসেন (পিতা হোসেন আলী), আবুল হোসেন (পিতা রফেদ আলী), হায়দার আলী তালুকদার (পিতা আফসার আলী তালুকদার), সোহরাব আলী ওরফে গেদা (পিতা মোকছেদ আলী), আব্দুস ছালাম, আবদুল আজিজ (পিতা হোসেন আলী), মোবারক হোসেন (পিতা মোকছেদ আলী), মো. জামাল উদ্দিন (পিতা ওসমান গনি), আব্দুল শেখ (পিতা রওশন আলী সরকার), মো. আশরাফ আলী তালুকদার (পিতা বছির উদ্দিন, পানকাতা), ওমর আলী (পিতা নুরুল ইসলাম, পানকাতা), মো. গিয়াস উদ্দিন (পিতা বছর উদ্দিন, পানকাতা), রমজান আলী (পিতা তোমেজ মিয়া, পানকাতা) ও গিয়াস উদ্দিন প্রামাণিক (পিতা নুরুল ইসলাম প্রামাণিক, পানকাতা)|
আহতদের ৩ জন হলেন- মো. লুৎফর রহমান (পিতা আব্দুর রশিদ), মো. আনোয়ার হোসেন (পিতা গুন্দা সরকার) ও শ্যামলী (পিতা হযরত আলী ফকির)। এদের বাড়ি মামুদপুর গ্রামে। [মামুন তরফদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৮ম খণ্ড