You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর উপজেলা (হবিগঞ্জ)

মাধবপুর উপজেলা (হবিগঞ্জ) ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ-এর সরকার গঠনের কথা থাকলেও ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর সারা দেশের ন্যায় মাধবপুরও অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে ওঠে। থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি তফাজ্জল হোসেন খোকা মিয়াকে আহ্বায়ক ও সেক্রেটারি হুমায়ুন আলী চৌধুরী ওরফে দুলাল চৌধুরীকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। প্রতিটি ইউনিয়নেও স্থানীয় কমিটি গঠন করা হয়। ২৩শে মার্চ মৌলানা আসাদ আলী এমপিএ জগদীশপুর জে সি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। এ-সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির নেতা তফাজ্জল হোসেন খোকা মিয়া, হুমায়ুন আলী চৌধুরী, মৌলানা মতিউর রহমান, সৈয়দ আশরাফুল হোসাইন ওরফে ফুল মিয়া, কাজী আব্দুল কাদির, রতিরঞ্জন দাশগুপ্ত, গোলাপ খাঁ, সৈয়দ ফারুক, মতিন, শরীফ, এনাম খাঁ, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, ফিরোজ আলী শাহ, মোহাম্মদ আলী পাঠান (থানা ছাত্রলীগ নেতা), আলী আহমদ, ঝারু মিয়া, সৈয়দ মোহাম্মদ শাহজাহান (ঢাকার জিন্নাহ কলেজ, বর্তমান তীতুমীর কলেজ-এ তখন ছাত্রলীগ নেতা) প্রমুখ। উত্তাল সেই দিনের রাজনৈতিক খবরাখবর এলাকাবাসীর নিকট পৌঁছে দেয়া এবং এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া জনসমক্ষে তুলে ধরার লক্ষ্যে মাধবপুরের কতিপয় প্রগতিশীল ব্যক্তি, যথা— পরিমল রায়, স্বপন চৌধুরী, সেলিম চৌধুরী প্রমুখ জয়বাংলা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। নোয়াপাড়াস্থ স্ট্যান্ডার্ড প্রিন্টিং প্রেস থেকে প্রকাশিত এ পত্রিকা স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনমত তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর পাকবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার কৌশল অর্জনের জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির ব্যবস্থাপনা ও মাধবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুসলিম উদ্দিন খানের সহযোগিতায় ১৩ই মার্চ থেকে সার্কেল অফিসারের অফিস-সংলগ্ন মিলনায়তনের সামনে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করা হয়। মুসলিম উদ্দিন খান প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও দুজন পুলিশ সদস্য দেন। তারা ছাড়াও এখানে আরো প্রশিক্ষক ছিলেন আনসার কমান্ডার মধু, জান্টু, অহিদ হোসেন পাঠান প্রমুখ। এ খবর পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দায়িত্ব পালনরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম রেজা কর্মসূচি পরিদর্শন করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং সেনাবাহিনীর দুজন প্রশিক্ষককে এখানে পাঠান ২৫শে মার্চ পর্যন্ত আলী আহমদ, ননী পাল, ঝারু মিয়া, নারায়ণ সেন, বসু পাঠান, আরজু মিয়া, সুনীল দাশ, সুকোমল রায়, আমীর হোসেন, আব্দুল মন্নান, আব্দুন নুর, বারিক মিয়া ও অলিউর রহমানসহ শতাধিক ছাত্র-যুবক এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য খাবারসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করা হতো। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন রতিরঞ্জন দাশগুপ্ত, শচীন্দ্র রায়, বিনোদ বিহারী মোদক ও মফিজ মাস্টার। এ- কাজে বাজারে অবস্থিত হুমায়ুন আলী চৌধুরীর ঘরটি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপনের পর ১লা এপ্রিল মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম সেখানে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করে গেরিলা প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এখানে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন সেনাবাহিনীর সদস্য সুবেদার আব্দুল করিম, সুবেদার আব্দুল মন্নান, হাবিলদার মো. আব্দুর রহমান (বড়ধলিয়া, মাধবপুর) প্রমুখ। এখানেও প্রচুর সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের খাদ্য সরবরাহের ব্যাপারে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি খুরশেদ আলম চৌধুরী (আওয়ামী লীগ), দেওয়ান আশরাফ, আব্দুস ছাত্তার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। জয়বাংলা পত্রিকার পক্ষ থেকেও সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। হাবিলদার মো.আবদুর রহমান ভারতের তুলাবাগান ক্যাম্পে প্রশিক্ষক হিসেবে দেড়মাস দায়িত্ব পালন করেন।
মাধবপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মৌলানা আসাদ আলী এমপিএ (মোহনপুর ইয়ুথ ক্যাম্প প্রধান), উপজেলা মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পলিটিক্যাল মটিভেটর), মৌলানা মতিউর রহমান (বাঘাসুরা), আওয়ামী লীগ নেতা মো. তফাজ্জল হোসেন খোকা মিয়া (আন্দিউড়া), হুমায়ুন আলী চৌধুরী (আন্দিউড়া), শহীদ উদ্দিন চৌধুরী (পিয়াইম), মতলব উদ্দিন চৌধুরী (পিয়াইম), আনোয়ার চৌধুরী (কড়রা), কাজী জিয়াউদ্দিন (সুন্দাদিল), মারুফ উদ্দিন চৌধুরী (পিয়াইম), মনিরুল বর চৌধুরী (বহরা), মোহাম্মদ আলী পাঠান (কৃষ্ণনগর), রতিরঞ্জন দাশগুপ্ত (মাধবপুর), কাজী কবির উদ্দিন (ঘোনাপাড়া), আব্দুল আলী শাহ (চৌমুহনী), দেওয়ান আশরাফ আলী (তেলিয়াপাড়া), সৈয়দ আশরাফুল হোসাইন ফুল মিয়া (চারাভাঙ্গা), গোলাপ খাঁ (বেজুড়া), শচীন্দ্র রায় (মাধবপুর), আলফাজ মিয়া (নোয়াপাড়া), বিনোদ বিহারী মোদক (মাধবপুর), কাজী আব্দুল কাদির (কালিকাপুর, বাঘাসুরা), শফিকুল হোসেন চৌধুরী (সুরমা), সেলিম চৌধুরী (আন্দিউড়া), ঝারু মিয়া, তাজুল ইসলাম (ধর্মঘর), ফজলুর রহমান চৌধুরী (বুড্ডা), জব্বার মিয়া (পাটুলী), আব্দুল মন্নান (বেলঘর), গোপাল ভট্টাচার্য (ছাতিয়াইন), মো. সৈয়দ মিয়া (আমবাড়িয়া), মো. নুরুল ইসলাম (কালিকাপুর, চৌমুহনী), অনন্ত চাষা (নোয়াপাড়া চা-বাগান), মোবারক আলী (বানেশ্বর), আব্দুল আলী তালুকদার (কালিকাপুর, বাঘাসুরা), মো. ছাহেব আলী (রিয়াজনগর), কামেশ কর (ভবানিপুর), শেখ মকসুদ আলী (দুর্গানগর) প্ৰমুখ।
২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ভোররাতে হবিগঞ্জে পৌঁছায়। মহকুমা আওয়ামী লীগ নেতা মানিক চৌধুরী পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে ২৬শে মার্চ হবিগঞ্জ থেকে মাধবপুর আসেন এবং মৌলানা আসাদ আলী এমপিএ-সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করেন। ইতোমধ্যে শতশত সাধারণ লোক নিজ উদ্যোগে সড়কপথের বিভিন্ন স্থানে গাছ, পাথর ইত্যাদি ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে। মানিক চৌধুরী তাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রতিটি ব্যারিকেড স্থলে গিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে চা-বাগান এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর তিনি থানায় গেলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুসলিম উদ্দিন খান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করে ১২টি রাইফেলসহ ১২ জন সিপাইকে তাঁর অধীনে প্রেরণ করেন। ইতোমধ্যে ছাত্র-জনতা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মাধবপুর থানা এলাকা থেকে চা-বাগান পর্যন্ত রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে। – এরপর মানিক চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রতিটি চা-বাগানেই চা- শ্রমিকরা তীরন্দাজ বাহিনী গঠন করে প্রতিরোধ আন্দোলনে শরিক হয়।
এদিকে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন নাসিম এবং সুবেদার মান্নান ঢাকা থেকে অগ্রসরমান পাকসেনাদের প্রতিরোধকল্পে আশুগঞ্জে প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী গানবোট, আর্টিলারি ও মর্টার নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর বিমান হামলা চালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা তখন পেছনে সরে এসে শাহবাজপুরে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। কিন্তু পাকবাহিনী শাহবাজপুরেও একই কায়দায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা ১৫ই এপ্রিল মাধবপুরে এসে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন নাসিম, সুবেদার মুজিবুর রহমান এবং লেফটেন্যান্ট মান্নান স্ব- স্ব সেনাদের নিয়ে মাধবপুরে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে তেলিয়াপাড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচও এ প্রতিরোধে অংশ নেয়। ২১শে এপ্রিল থেকে ২৮শে এপ্রিল পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে দুশতাধিক পাকসেনা হতাহত হয় এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন। পাকবাহিনীর বেপরোয়া আক্রমণে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ-যুদ্ধ মাধবপুর প্রতিরোধ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এদিনই মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ অবস্থানে পাকবাহিনী বিমান, সড়ক ও নৌপথে আক্রমণ চালিয়ে মাধবপুরে প্রবেশ করে এবং মাধবপুর বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়িসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনীর এ হামলায় অহিদ হোসেন পাঠানসহ ১৫ জন সাধারণ লোক শহীদ হন। এ ঘটনা মাধবপুর থানা সদর গণহত্যা নামে পরিচিত। এরপর পাকবাহিনী মাধবপুর ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করে পরদিন ২৯শে এপ্রিল জগদীশপুর পর্যন্ত রাস্তার পার্শ্ববর্তী মীননগর, হারিয়া, বাকসাইর, আন্দিউড়া ও বেজুরা গ্রামে বহু বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ৩০শে এপ্রিল তারা শাহজীবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের রেস্টহাউজে দ্বিতীয় ক্যাম্প এবং পরবর্তী সময়ে ধর্মঘর বাজার, জগদীশপুর জে সি হাইস্কুল, আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা হাইস্কুল, শাহজাহানপুর স্কুল, মনতলা বাজার, তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ও সুরমা চা-বাগান বাংলোয়ও ক্যাম্প স্থাপন করে।
মাধবপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয়দের প্রধান ছিল ইটাখোলা গ্রামের সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার (পিতা সৈয়দ মোহাম্মদ সঈদ উদ্দিন)। তার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০২০ সালে সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক তার মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়— যা কার্যকর হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তার সঙ্গে আরো ছিল ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি জাহেদ উদ্দিন চৌধুরী (ছাতিয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান)।
মাধবপুর উপজেলায় স্বাধীনতাবিরোধী দল হিসেবে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী- ও পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির সীমিত কিছু কার্যক্রম ছিল। পাকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে এসব দলের নেতা-কর্মীরা মাধবপুর উপজেলা ও এর প্রতিটি ইউনিয়নে শান্তি কমিটি গঠন করে। পাকবাহিনী তাদের সহযোগিতার জন্য রাজাকার বাহিনীও গঠন করে। রাজাকাররা বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ রেল ও সড়কপথে পাকবাহিনীর যাতায়াত নির্বিঘ্ন করার জন্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে।
পাকবাহিনী মাধবপুরে প্রবেশের পর ৩০শে এপ্রিল শাহপুর এসে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগসহ কয়েকজনকে হত্যা করে। সেখান থেকে শাহজীবাজারে এসে পুরাইকলা গ্রামের আব্বাস আলী ও বাঘাসুরা গ্রামের মকসুদ মিয়াকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করলে আব্বাস আলী মৃত্যুবরণ করেন, তবে মকসুদ মিয়া বেঁচে যান। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তেলিয়াপাড়া রেলস্টেশনের কাছে কালিচরণ নামে এক অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি এবং ফজলু মিয়া চৌধুরী নামে অপর একজনকে গুলি করে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য পরিবেশনের অভিযোগে ৬ই মে আবুল মিয়া ও জয়নাল মিয়াকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে জগদীশপুর হাইস্কুলে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করে।
১২ই মে তেলিয়াপাড়া বাজারে পাকসেনারা বহু লোককে হত্যা করে। এ ঘটনা তেলিয়াপাড়া বাজার গণহত্যা নামে পরিচিত। ১৬ই জুন তেলিয়াপাড়ার আবুল মিয়া ও তাঁর ভাই আশু মিয়াকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। পরদিন বদরুল হোসেন ও তাদের কাজের লোক এরশাদ আলীকে রেলস্টেশনের কাছে একটি নিম গাছের তলায় গুলি করে হত্যা করে।
জুন মাসের প্রথমার্ধে এক রাতে মনতলা রেলস্টেশনের কাছে ভারতগামী ১৮ জন শরণার্থীর ওপর পাকসেনারা হামলা চালালে ১৭ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এ ঘটনা মনতলা রেলস্টেশন গণহত্যা নামে পরিচিত। আবজলপুরে আসকর আলী, নুরুল ইসলাম, ইন্তেজ আলী, আব্দুল কাদির, গোলাম হোসেন ও রেলওয়ের পয়েন্টসম্যান আক্কাস আলীও পাকবাহিনীর হত্যার শিকার হন। ঘিলাতলীর মুক্তিযোদ্ধা দেওয়ান ছকু মিয়া মনতলা স্টেশনে অপারেশনে এসে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন এবং হানাদাররা তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। হানাদারদের একটি দল উত্তর সুরমা গ্রামের কয়েকজন লোককে ধরে এনে আনসার সদস্য আয়ুব আলীর ঘরে আটকে রাখে। পরে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে আগুন ধরিয়ে দেয়। আয়ুব আলী দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে এক পাকসেনাকে জাপটে ধরে তার হাতের অস্ত্র কেড়ে নেন। কিন্তু অপর এক পাকসেনার গুলিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। এ-সময় যারা ঘর থেকে বের হয়েছেন তারাই পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হয়েছেন। আর যারা বের হতে পারেননি তারা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এ ঘটনা উত্তর সুরমা গণহত্যা নামে পরিচিত।
জুন মাসেই পাকসেনারা মাধবপুরের পূর্বদিকে সুলতানপুর গ্রামে গিয়ে আবদুর রহমান ও ইউনুছ আলীকে হত্যা করে। সুলতানপুর যাওয়ার পথে তারা আরো কয়েকজনকে হত্যা করে তাদের লাশ একটি গর্তে মাটিচাপা দেয়। অগ্নিসংযোগ করে তারা আলাউদ্দিন, সুবে রহমান, শহীদ চৌধুরী, আব্দুল মালেক, সুরেশচন্দ্র শীল, রাজেন্দ্র শীল, কাঁচা শীল, দীনেশ শীল প্রমুখের বাড়ি ভস্মীভূত করে। সুলতানপুরেই অপর একদিন হত্যা করে চারু মিয়া ও রমেশ সরকারকে। শাহবাজপুরের আলফু মিয়াকেও ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। ১৫ই জুলাই কয়েকজন পাকসেনা রতনপুর গ্রামের দুবরাজ বেগমকে ধর্ষণ করে। ১৬ই জুলাই কালিকাপুর গণহত্যা সংঘটিত হয়। এতে ৬ জন গ্রামবাসী শহীদ হন|
পাকসেনারা সুরমা চা-বাগানে প্রায়ই হামলা চালাত। তাদের হামলায় উক্ত বাগানের বিহারী অন্তরায়, প্রেমসিং মাক্লিমন্ডা, চান্দা মন্ডা, বিদ্যাচরণ বাগচী, বলিগোর, চুনু সাঁওতালসহ বহু শ্রমিক-কর্মচারী প্রাণ হারান। নোয়াপাড়া বাগানের সুবোধ রাম তাঁতীকে ধরে নিয়ে জগদীশপুর তেমুনিয়ায় নির্মম – নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয়। এ বাগানের সহদেব ঘোষ ও শঙ্কর ঘোষও পাকবাহিনীর হত্যার শিকার হন। এভাবে প্রত্যেক বাগানেই পাকসেনারা নিরীহ শ্রমিকদের নির্বিচারে হত্যা করে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাকসেনারা ১২৭ জনকে হত্যা করে বলে জানা যায়। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়েও বেশি হবে।
পাকবাহিনী শাহজীবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের রেস্টহাউজ, জগদীশপুর জে সি হাইস্কুল, আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা হাইস্কুল, শাহজাহানপুর স্কুল, তেলিয়াপাড়া চা- বাগান ও সুরমা চা-বাগান বাংলোকে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করত। বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে নিরীহ লোকদের ধরে এনে এসব বন্দিশিবিরে নির্মমভাবে নির্যাতন করত। নারীদেরও এসব কেন্দ্রে ধর্ষণ-নির্যাতন করা হতো।
মাধবপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা বেশ কয়েকটি যুদ্ধ, এম্বুশ ও অপারেশন পরিচালনা করেন। সেগুলো হলো— তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার্স যুদ্ধ তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাট সড়কে এম্বুশ , আন্দিউড়া এম্বুশ, তেলিয়াপাড়া এম্বুশ, হরিতলা রেলসেতু অপারেশন, মনতলা যুদ্ধ, সুন্দরপুর যুদ্ধ, ধর্মঘর। বাজার যুদ্ধ, হরষপুর রেলসেতু অপারেশন এবং ধর্মঘর যুদ্ধ। তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার্স যুদ্ধ সংঘটিত হয় ৬ই মে। এদিন পাকবাহিনী ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)-এর ছদ্মবেশে এসে আকস্মিকভাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার্স আক্রমণ করে।। মুক্তিযোদ্ধারা সাহসিকতার সঙ্গে এ আক্রমণ প্রতিহত করেন। এক পর্যায়ে পাকবাহিনীর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তারা। পিছু হটে। তাদের কয়েকজন সেনা নিহত হয়। এ-যুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ল্যান্স নায়েক আব্দুর রহমান অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন।
তেলিয়াপাড়া-চুনারুঘাট সড়কে এম্বুশ রচিত হয় ১১ই মে। পাকবাহিনী এ সড়ক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করত। হঠাৎ ১০ই মে তারা জগদীশপুর ক্যাম্প থেকে তেলিয়াপাড়ার দিকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। এর জবাব দেয়া এবং এই রুটে তাদের যাতায়াত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ১১ই মে লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী সড়কের সুবিধাজনক স্থানে মাইন পুঁতে এম্বুশ রচনা করেন। এক পর্যায়ে গোলন্দাজ বাহিনীর ছত্রছায়ায় পাকবাহিনীর একটি সামরিক কনভয় তেলিয়াপাড়া থেকে চুনারুঘাটের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কনভয়ের প্রথম জিপটি চলে যায়। এরপর একটি ট্রাকও অক্ষত অবস্থায় চলে যায়। তৃতীয়বার একটি মালবোঝাই ট্রাক এগিয়ে এলে তার চাপে একটি মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য মাইনগুলোও বিস্ফোরিত হয়। একই সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মোরশেদের যোদ্ধারাও শত্রুদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করেন। উভয় পক্ষে দীর্ঘক্ষণ গোলাগুলির পর পাকবাহিনী পালিয়ে যায়। এখানে শত্রুদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রসহ পাকবাহিনীর একটি বাস অক্ষত অবস্থায় দখল করেন।
আন্দিউড়া এম্বুশ রচিত হয় ১৪ই মে। মে মাসে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পাকসেনাদের যাতায়াত বিঘ্নিত করার জন্য বেশ কয়েকটি সেতু ধ্বংস ও এম্বুশ রচনা করেন। তারই একটি হচ্ছে আন্দিউড়া এম্বুশ। এজন্য লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদ ১৩ই মে ১২ জন সৈন্য নিয়ে মাধবপুর ইউনিয়নের বাগসাইর গ্রামে অবস্থান নেন। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে আন্দিউড়া উম্মেতুন্নেছা হাইস্কুলে পাকসেনাদের একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পের সেনারা ইতঃপূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা বিধ্বস্ত এখানকার একটি সেতুর বিকল্প নির্মাণ করে তাদের যাতায়াত অব্যাহত রাখছিল। মুক্তিযোদ্ধারা এটি ধ্বংসের জন্যই এম্বুশ রচনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট স্থানে দুটি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন পুঁতে তাঁরা শত্রুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। পরদিন ১৪ই মে বেলা ৩টার দিকে পাকসেনাদের একটি কনভয় সিলেট থেকে এদিকে আসতে থাকে। কনভয়ের সামনের জিপটি ডাইভারশন রোডে প্রবেশ করতেই মাইনের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে প্রথম দুটি জিপ রাস্তার বাইরে ছিটকে পড়ে বিধ্বস্ত হয় এবং কনভয়টি থেমে যায়। বিশাল এই কনভয়ে প্রায় ৩০০ পাকসেনা ছিল। মাইন বিস্ফোরণের সঙ্গে-সঙ্গে লেফটেন্যান্ট মোরশেদ শত্রুদের ওপর তীব্র আক্রমণ চালান। শত্রুরাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। আকস্মিক এ আক্রমণে শত্রুপক্ষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে পরিস্থিতি তাঁদের প্রতিকূলে বুঝতে পেরে লেফটেন্যান্ট মোরশেদ তাঁর বাহিনী নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।
পাকসেনারা তাঁদের ধরতে না পেরে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
তেলিয়াপাড়া এম্বুশ রচিত হয় ১৬ ও ১৯শে মে দুদিন। এতে নেতৃত্ব দেন যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মতিন ও লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদ। দুদিনের এম্বুশ ও তৎপরবর্তী ২০শে মে-র যুদ্ধে শতাধিক পাকসেনা হতাহত হয় এবং ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ল শহীদ হন। ১৯ তারিখের এম্বুশে মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের দুটি ট্রাক ধ্বংস ও একটি দখল করেন। তবে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনীর তীব্র আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। হরিতলা রেলসেতু অপারেশন পরিচালিত হয় ১৫ই জুন লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বে। পাকবাহিনীর সৈন্য ও রণসামগ্রী পরিবহণ ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এ অপারেশনে পাকসেনা বহনকারী একটি ট্রেন বিধ্বস্ত এবং প্রায় ১৫০ পাকসেনা নিহত হয়।
মনতলা যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২১শে জুন। ২০শে মে তেলিয়াপাড়া পতনের পর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যোদ্ধারা সীমান্তবর্তী মনতলা, হরষপুর ও সিংগারবিল এলাকায় তাঁদের অবস্থান সংহত করে মনতলায় শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করেন। এর ফলে আখাউড়া-সিলেট রেলপথ এবং ঢাকা-সিলেট সড়ক পথে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী হয়। এদিকে ১৫ই জুনের পর থেকে পরিখা খননের মাধ্যমে পাকসেনারা মনতলা রেলওয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। দিনের বেলা তারা পরিখা থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্র ব্যবহার করত এবং ইটাখোলা ও মাধবপুর থেকে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখত। রাতের বেলা আক্রমণের তীব্রতা বাড়াত। পাঁচদিন ধরে এরূপ অবস্থা চলার পর ২০শে জুন পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির কাছাকাছি চলে আসে। ২১শে জুন সকালে ৪ ব্যাটালিয়ন সৈন্য সমাবেশ করে পাকবাহিনী তিন দিক থেকে মনতলা ঘাঁটিতে বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। হেলিকপ্টারের সাহায্যে লক্ষ্য নির্ধারণপূর্বক গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ চলতে থাকে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের মনতলা ঘাঁটির পতন হয়।
সুন্দরপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৬ই জুলাই। পাকসেনা কর্তৃক রতনপুর গ্রামের এক নারী ধর্ষিতা হওয়ার প্রতিবাদে স্থানীয় লোকজন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাদের আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাকবাহিনী প্রথমে পিছু হটলেও পরে শক্তি বৃদ্ধি করে পুনরায় ফিরে এসে প্রতিআক্রমণ চালায়। তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে মো. ইসলাম উদ্দিন নামে একজন গ্রামবাসী শহীদ ও একজন মুক্তিযোদ্ধাসহ দুজন গ্রামবাসী আহত হন।
ধর্মঘর বাজার যুদ্ধ সংঘটিত হয় জুলাই মাসের শেষদিকে। ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছে ধর্মঘর বাজারে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। সুবেদার আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল এ ক্যাম্প আক্রমণ করে। পাকবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। এ-যুদ্ধে একজন মেজরসহ ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
হরষপুর রেলসেতু অপারেশন পরিচালিত হয় আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধারা হরষপুর রেলস্টেশনের দক্ষিণে একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেন। পাকবাহিনী তাদের যোগাযোগের সুবিধার্থে সেতুটির মেরামত কাজ শুরু করে। কিন্তু লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদ এ- কাজে তাদের বাধা দেয়ার জন্য অপারেশনের প্রস্তুতি নেন ৷ এ অপারেশনে তাঁর সঙ্গে ছিলেন কমান্ডার নাছির ও সুবেদার মান্নানসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। কমান্ডার নাছির এক প্লাটুন সৈন্য, ভারী মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার নিয়ে গন্তব্যস্থলে পৌছান। তখন বেশ কয়েকজন রেলকর্মী মেরামতের কাজ করছিল। মুক্তিবাহিনী একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে অতর্কিতে মেশিনগান থেকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। পাকসেনারা পাল্টা আক্রমণের কোনো সুযোগ পায়নি। কিছু সময় পরে পাকবাহিনীর মনতলা ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ১০৫ মিলিমিটার ব্যাসের কামানের গোলা নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যান। এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর বহু সৈন্য নিহত হয়।
ধর্মঘর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৪শে আগস্ট ও ২৮শে সেপ্টেম্বর। উপজেলার সর্বদক্ষিণে ধর্মঘর ইউনিয়নের অবস্থান। তেলিয়াপাড়া থেকে মনতলা হয়ে একটি রাস্তা এসে ধর্মঘরকে তেলিয়াপাড়ার সঙ্গে যুক্ত করেছে। ধর্মঘরে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী নিয়মিত প্লাটুন ছিল। তাদের সঙ্গে এক কোম্পানি রাজাকারও ছিল। ইতঃপূর্বে ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া এ অঞ্চলে ছোট-ছোট কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেছেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিয়ে তাঁকেই কমান্ডার করে ধর্মঘর আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়। পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে অপারেশন পরিচালিত হয়। উত্তরে চৌমুহনী বাজারে প্রতিবন্ধকতা তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় ক্যাপ্টেন মতিন ও ক্যাপ্টেন নাসিমকে। পশ্চিম দিকে আহমদপুরের দায়িত্ব দেয়া হয় লেফটেন্যান্ট হেলাল মোরশেদকে। দক্ষিণ দিকে মালঞ্চপুর সীমান্ত অতিক্রম করে শত্রুদের অবস্থানের ওপর হামলার দায়িত্ব নেন ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া। ভারতীয় মাউন্টেইন ব্যাটারি থেকে গোলন্দাজ সহযোগিতার নিশ্চয়তা পাওয়ার পর ৩রা সেপ্টেম্বর রাত ৩টায় আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। যথাসময়ে মুক্তিযোদ্ধারা লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি পৌঁছান। কিন্তু প্রচণ্ড বৃষ্টি, তীব্র শীত ও গভীর অন্ধকারের কারণে আক্রমণ না করেই এদিন তাঁদের ফিরে আসতে হয়। দ্বিতীয়বার আক্রমণের দিন-ক্ষণ ধার্য হয় ২৮শে সেপ্টেম্বর ভোর ৫টায়। মূল অভিযান চৌমুহনী বাজার থেকে শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। ব্যাপক গোলন্দাজ সহযোগিতারও ব্যবস্থা করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুর অবস্থানের ওপর আক্রমণপূর্ব বোমাবর্ষণ শুরু হয়। পাকবাহিনীও পাল্টা বোমাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি অগ্রবর্তী সেনাদলের সামনে স্থাপিত তিনটি ভারী মেশিনগানের গোলাবর্ষণ উপেক্ষা করে ভারতীয় ১৮তম রাজপুত রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানি পাকিস্তানিদের অবস্থানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মেশিনগানের সামনে রাজপুত ব্যাটালিয়নের অবস্থা নড়বড়ে হয়ে ওঠে। সকাল ১০টা পর্যন্ত ব্যাপক হতাহত হওয়া সত্ত্বেও উভয় পক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিকূলতার কারণে অভিযান প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া আরো কয়েকটি অপারেশন ও যুদ্ধ হলো- হবিগঞ্জ গ্যাস ফিল্ড অপারেশন মৌজপুর যুদ্ধ, নোয়াপাড়া অপারেশন, মাধবপুর থানা সদর অপারেশন এবং ভবানীপুর অপারেশন। ৬ই ডিসেম্বর মাধবপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুর রহমান, বীর বিক্রম (পিতা নাম শাহ আব্দুর রহিম, বড়ধলিয়া)। মাধবপুর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আক্কাছ আলী (পিতা সৌর উদ্দিন, মৌজপুর; আনসার সদস্য), রফিকুল আলম চৌধুরী (পিতা আব্দুল গফুর চৌধুরী, সুরমা), হাবিলদার অহিদ হোসেন পাঠান (পিতা সুরুজ আলী পাঠান, কৃষ্ণনগর), রহম আলী (পিতা করম আলী, গাঙ্গাইল), বসরত উল্লাহ (পিতা হাজী হাসমত উল্লাহ, শিবরামপুর; আনসার সদস্য), আমির হোসেন (পিতা লতিফ হোসেন, কমলাপুর), নাজিম উদ্দিন (পিতা আফছার উদ্দিন, শাহপুর), আবদুল খালেক (১৬ই মে তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে শহীদ), দেওয়ান ছকু মিয়া (পিতা দেওয়ান আব্দুল মতিন, ঘিলাতলী; ২১শে জুন মনতলা যুদ্ধে শহীদ), নায়েক নিজামুদ্দিন (২০শে মে তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে শহীদ), ল্যান্স নায়েক আসলাম মিয়া (ঐ), সিপাহি মোবারক আলী (ঐ), রঙ্গু মিয়া (ঐ), গফফার মিয়া (ঐ), আলী আজম ভূঁইয়া (ঐ), জালালুদ্দিন (ঐ), আবু মিয়া (ঐ), মোজাহিদ (ঐ), গিয়াস উদ্দিন (ঐ), আলকাস মিয়া (ঐ), মো. ইসলাম উদ্দিন (পিতা নছম উদ্দিন, রূপনগর; ১৬ই জুলাই সুন্দরপুর যুদ্ধে শহীদ), আবুল খায়ের (সুরাবই), লাল মিয়া (পিতা বাবর আলী, মৌজপুর), নলি লাল ঘটোয়াল (পিতা সরদার, সুরমা চা-বাগান), সুবোধ তাঁতী (পিতা মশা তাঁতী, নোয়াপাড়া চা-বাগান), আবদুর রহমান বাচ্চু মিয়া (পিতা আব্দুল ওয়াহাব, মঙ্গলপুর), নাজিম উদ্দিন (পিতা মো. আফসার উদ্দিন, শাহপুর), এম এ ফারুক (আখিতারা), এবং আব্দুল জলিল (দুর্গানগর গ্রামে সমুজ আলরি আমবাগানে সমাহিত)।
মাধবপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তেলিয়াপাড়া চা-বাগান ডাকবাংলোর সামনে বুলেট আকৃতির একটি স্মৃতিসৌধ ও শাহজীবাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্দিশিবির ও নির্যাতন কেন্দ্রে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে জগদীশপুর তেমুহনীয়াস্থ চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ চত্বর। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!