বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার রিপোর্টার মানস ঘোষ
মানস ঘোষ (জন্ম ১৯৪৩) বিদেশী সাংবাদিক হিসেবে মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রথম সংবাদ প্রতিবেদন রচনাকারী। ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকার রিপোর্টার মানস ঘোষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একাধিকবার বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার দৃশ্য সংগ্রহ করে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তাঁর প্রতিবেদন সারা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম ও ভারতের সরকারি পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি ‘ওয়ার করসপন্ডেন্ট’ হিসেবে ৭১-এর নভেম্বরে মিত্রবাহিনী-র সঙ্গে বাংলাদেশে এসে যুদ্ধক্ষেত্রের ওপর প্রতিবেদন রচনা করেন। তাঁর এসব প্রতিবেদন বাংলাদেশে পাকবাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ ও স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের মরণপণ সংকল্প ও সংগ্রামের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে Bangladesh Liberation War সম্মাননা প্রদান করে।
মানস ঘোষ ১৯৪৩ সালের ৩০শে আগস্ট দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লিতে অধ্যয়ন শেষে তিনি সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি কলকাতার জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক স্টেটসম্যান এর তরুণ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর কোনো পূর্ব-সম্পর্ক না থাকায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্বন্ধে প্রথমে তাঁর খুব একটা আগ্রহ ছিল না। কিন্তু ২৭শে মার্চের একটি ছোট ঘটনা তাঁকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত মানুষে পরিণত করে। সে-সময়ের কংগ্রেস নেতা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র আস্থাভাজন দুই রাজনীতিবিদ ভূপেন গুপ্ত ও সুখময় চক্রবর্তীর সঙ্গে এদিন তাঁর দেখা হয়। তাঁরা দুজন জন্মগতভাবে ঢাকার লোক ও ঢাকায় পড়াশোনা করেছেন। তাঁরা মানস ঘোষের কাছে ঢাকার পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে অজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এ দুই নেতা স্টেটসম্যান-এর মতো পত্রিকার সাংবাদিক হিসেবে তাঁর এ অজ্ঞতার জন্য তাঁকে ভর্ৎসনা করেন। এ ঘটনা তরুণ মানস ঘোষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে পরের দিন তিনি অফিসের অনুমতি না নিয়েই বনগাঁ সীমান্তের কাছে যান। যশোর রোড দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেউ আসছেন কিনা সেজন্য অপেক্ষা করেন। সারাদিন অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় তিনি ঢাকা থেকে যাওয়া এক ইতালীয় নাগরিকের সাক্ষাৎ পান। তিনি ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ছিলেন। ঐ রাতে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কীভাবে দি পিপলস পত্রিকা অফিসে বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের হত্যাযজ্ঞ এবং শহরের অন্যান্য স্থানে অবিরাম গুলিবর্ষণ, হত্যা ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল ইত্যাদি সম্পর্কিত তথ্য মানস ঘোষকে দেন। এসবের ভিত্তিতে মানস ঘোষ একটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেন। রিপোর্টটি পরদিন স্টেটসম্যান-এর প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। এ খবর সারা ভারতের রাজনৈতিক ও সাংবাদিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পরদিন তিনি পত্রিকার চিফ ফটোগ্রাফারকে নিয়ে ভোমরা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা সাতক্ষীরা ও যশোরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেন। যশোরের চাচোর রাজবাড়িতে পাকসেনাদের হাতে নিহত অনেক নারী, পুরুষ ও শিশুর রক্তাক্ত মৃতদেহ তাঁরা দেখতে পান। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটার সময় প্রতিশোধ নিতে এসব নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তখন মানস ঘোষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য কীভাবে প্রস্তুত হচ্ছে, তা প্রত্যক্ষ করেন। কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি যে রিপোর্ট করেন, তা পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশে ঢুকে তথ্য সংগ্রহ করে কোনো বিদেশী সাংবাদিকের লেখা প্রথম রিপোর্ট। এ রিপোর্ট কেবল ভারতে নয়, সারা পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। রিপোর্টটি প্রকাশের পর বিভিন্ন দেশ থেকে সাংবাদিকরা ভারতের দিল্লি ও কলকাতায় আসতে থাকেন। এরপর গেদে-দর্শনা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মানস ঘোষ নিয়মিত যুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে তাঁর পত্রিকায় প্রচার করতে থাকেন। এপ্রিল মাসে পাবনায় এসে মানস ঘোষ পুরুষের বেশে যুদ্ধরত নারী মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল-এর সাক্ষাৎ পান। তাঁকে নিয়ে লেখা তাঁর প্রতিবেদন ‘A shy girl with a gun’ শিরোনামে স্টেটসম্যান-এর প্রথম পাতায় ছাপা হয় ৷ প্রতিবেদনটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়। এ রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ- তাঁকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর কাছ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের তথ্য জানতে চান। আগস্ট মাসে মানস ঘোষ সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। এ-সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের গুলি বিনিময়ের মাঝখানে পড়েন এবং অল্পের জন্য জীবনে রক্ষা পান। সেপ্টেম্বরে পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ওয়ার করসপন্ডেন্ট’ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ২১শে নভেম্বর তিনি বনগাঁ-বয়ড়া সীমান্তের গরিবপুরে পাকবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধ কভার করেন। ডিসেম্বরে সংঘটিত খুলনার ফুলতলা যুদ্ধও তিনি প্রত্যক্ষ করেন। ৪ দিন ধরে চলা এ-যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ-যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর বিস্তারিত রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে সাহসী ভূমিকা পালন এবং বিশ্ব জনমত গঠনে মূল্যবান অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২০শে অক্টোবর মানস ঘোষকে Friends of Liberation War সম্মাননা প্রদান করে। স্বাধীনতার পর তিনি স্টেটসম্যান-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। এ-সময় তিনি ঢাকায় থাকতেন। ঢাকায় থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। উদার রাষ্ট্রনেতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তিনি গভীরভাবে অনুরক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মানস ঘোষকে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হয়নি। কলকাতা থেকে ২০০৪ সালের ২৮শে জুন বাংলা স্টেটসম্যান-এর প্রকাশনা শুরু হলে তিনি এ পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ২০১৫ সালে তিনি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি কলকাতায় বসবাস করছেন। [জালাল আহমেদ]
তথ্যসূত্র: হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ত্রয়োদশ খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ঢাকা ২০১০; স্নেহাশিস সুর (সংকলিত ও সম্পাদিত), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : কলকাতার সাংবাদিকরা ও প্রেস ক্লাব কলকাতা, প্রেস ক্লাব, কলকাতা ২০১৯
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড