You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্থানীয় মুক্তিবাহিনী মানিক বাহিনী (ঝালকাঠি)

মানিক বাহিনী (ঝালকাঠি) ঝালকাঠি সদর উপজেলার একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান ছিলেন রেজাউল করিম আজাদ ওরফে মানিক। তিনি ঢাকা কলেজের বিএ ক্লাসের ছাত্র এবং কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্নাতক শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি গ্রামে চলে আসেন এবং এলাকার যুবকদের সংগঠিত করে একটি ক্ষুদ্র ‘গার্ড বাহিনী’ গড়ে তোলেন, যা পরবর্তিতে তাঁর নামানুসারে ‘মানিক বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এ বাহিনীর ২৪ জন সদস্যের সকলেই ছিলেন বেশাইনখান গ্রামের অধিবাসী। তাঁরা হলেন: রেজাউল করিম আজাদ মানিক (পিতা এ বি এম হাতেম আলী মোল্লা), মো. সাইদুল করিম রতন (মানিকের সহোদর ছোটভাই এবং কীর্তিপাশা হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র), মো. সালাহ উদ্দিন মজনু (পিতা আমজাদ হোসেন), মহেন্দ্র নাথ হালদার (পিতা পার্বতী চরণ হালদার), আব্দুস ছাত্তার বিএ (পিতা আজাহার আলী মোল্লা), সৈয়দ আবু বকর (প্রাইমারি শিক্ষক), আবদুল করিম মোল্লা, হাবিবুর রহমান মোল্লা (পিতা আজাহার আলী মোল্লা), আবদুল খালেক মোল্লা (পিতা আবদুল কাদের মোল্লা), আবদুর রহিম মোল্লা (পিতা আলিম উদ্দিন মোল্লা), ওয়াহাব আলী মোল্লা (পিতা বুরজুগ আলী মোল্লা), আবদুল মান্নান (পিতা তোফেজ হাওলাদার), দলিল উদ্দিন (পিতা গঞ্জে আলী হাওলাদার), মোক্তার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন (পিতা নূর মোহম্মদ মোল্লা), এনায়েত হোসেন (পিতা নূর মোহম্মদ মোল্লা), জহুর হোসেন, ইসমাইল হোসেন (পিতা গফুর মোল্লা), আবদুল মালেক (পিতা ছোটন মোল্লা), মোবাশ্বের হোসেন (পিতা দরবার মোল্লা), খলিলুর রহমান (পিতা দরবার মোল্লা), আবদুল মজিদ মোল্লা, মোশারফ হোসেন (পিতা আপ্তাব উদ্দিন মোল্লা) এবং রাশেদ আলী মোল্লা (পিতা এলাদ উদ্দিন মোল্লা)। মো. সাইদুল করিম রতন ছিলেন মানিকের অন্যতম সহকারী। বেশাইনখান গ্রামে ছিল এ বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে চব্বিশ জনের এই ক্ষুদ্র গেরিলা দলটি বিভিন্ন সময়ে পাকবাহিনীর ওপর দুঃসাহসিক অভিযান চালায়।
যুদ্ধের সময় আটঘর-কুড়িয়ানা, ভীমরুলী, ডুমুরিয়া প্রভৃতি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার মানুষ হানাদার বাহিনীর ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে আটঘর-কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নেয়। মানিক বাহিনী তাদের পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি রক্ষা এবং সহায়- সম্বলহীন মানুষদের যথাসম্ভব সহায়তা করত। ৮ই জুন পাকবাহিনী পেয়ারা বাগানের ১০ মাইল এলাকা জুড়ে কারফিউ জারি করে এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এনে পেয়ারা বাগান কাটতে শুরু করে। এ খবর পেয়ে ১০ই জুন মানিক বাহিনী এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে পাকবাহিনীর একটি স্পিডবোট ও কয়েকটি রাইফেল হস্তগত করে। এ ঘটনার পর পাকবাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে মানিক বাহিনীর খোঁজ করতে থকে। স্থানীয় রাজাকাররা মানিক বাহিনীর গোপন ঘাঁটিগুলোর খবর সংগ্রহ করে পাকবাহিনীকে জানিয়ে দেয়। সেই খবরের ভিত্তিতে ২০শে জুন ভোররাতে প্রায় ৫০০ পাকসেনা রাজাকারদের সহযোগিতায় বেশাইনখান ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে মানিক-রতনসহ দলের ২৪ জন সদস্যকেই আটক করে। তারা ঘটনাস্থলেই ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে এবং মানিক-রতনসহ ৮ জনকে ঝালকাঠি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে এ অঞ্চলের অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য আদায়ের জন্য তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন আজমত হায়াত মালিক খান নির্মম নির্যাতন চালিয়েও তাঁদের কাছ থেকে কোনো তথ্য আদায় করতে পারেনি। অবশেষে তাঁদের সকলকে সুগন্ধাতীর বধ্যভূমি তে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার পরে মানিক বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বেশাইনখান গ্রামের নতুন নামকরণ করা হয় ‘মানিক নগর’। পরে সেখানে শহীদ স্মৃতি মাধ্যমিক বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং আরো পরে স্থানীয়দের উদ্যোগে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। ১৯৭২ সালে ঢাকা শহরের ১৮২নং নয়া পল্টনে প্রতিষ্ঠিত আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে মানিক বাহিনীর কমান্ডারের স্মরণে শহীদ মানিক আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় রাখা হয়। এছাড়া ঐ এলাকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয় শহীদ মানিক সড়ক।
যেসব রাজাকার মানিক বাহিনীর সদস্যদের ধরিয়ে দিয়েছিল, তারা হলো: সাহাবুদ্দিন সাজি (গোবিন্দ ধবল), আলী হোসেন হাওলাদার (দিয়াকুল, পোনাবালিয়া), আশরাফ আলী খান (মহদিপুর, পোনাবালিয়া), সফিজ উদ্দিন সরদার (রমানাথপুর), আবদুর রউফ (রমানাথপুর), মোবাশ্বের মোল্লা (বেশাইনখান), আজাহার আলী মিঞা তার পাশা, কীর্তিপাশা) প্রমুখ। [শ্যামল চন্দ্র সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!