You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাদার তেরেসা

মাদার তেরেসা (১৯১০-১৯৯৭) আলবেনীয় বংশোদ্ভূত ভারতীয় নাগরিক, ক্যাথলিক সন্যাসী, দুঃস্থ মানবতা সেবী, দ্য মিশনারিস অব চ্যারিটি-র প্রতিষ্ঠাতা, নোবেল শান্তি পুরস্কার ও ভারতরত্ন উপাধিপ্রাপ্ত, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালি শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণকার্যের পরিচালক, শরণার্থীদের দুর্বিষহ জীবন ও কলেরায় শিশু-বৃদ্ধের মৃত্যু নিয়ে অক্সফাম প্রকাশিত দ্য টেস্টিমোনি অব সিক্সটি (২১শে অক্টোবর ১৯৭১)-র অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক Friends of Liberation War সম্মাননা প্রাপ্ত। মাদার তেরেসা ১৯১০ সালের ২৬শে আগস্ট আলবেনিয়া রাজ্যের স্কপিয়েতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নিকোলো ও মাতার নাম দ্রানাফিল বোজাজিউ বার্নাই। তাঁদের তিন সন্তানের মধ্যে মাদার তেরেসা ছিলেন কনিষ্ঠ তাঁর শৈশবের নাম ছিল অ্যাগনিস গঞ্জা বোজাজিউ। পরবর্তীতে তিনি মাদার তেরেসা নামে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেন। মাত্র ৮ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। মা তাঁকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন। ১২ বছর বয়সে তিনি সন্ন্যাস-জীবন গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। সে উদ্দেশ্যে ১৮ বছর বয়সে তিনি আয়ারল্যান্ডের ‘Sisters of Loreto’-তে যোগ দেন। ১৯২৯ সালের শুরুতে তিনি প্রথমে কলকাতা এবং সেখান থেকে দার্জিলিং আসেন। এখানে মিশনারি প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেন ও বাংলা ভাষায় শিক্ষা নেন। পরবর্তীতে হিন্দি ভাষায়ও পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি দার্জিলিং ও কলকাতায় লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন।
কলকাতার দারিদ্র্য, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে অগণিত মানুষের মৃত্যু, ১৯৪৬ সালের ১৫ই আগস্ট কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগ-ব্যাধিতে মানুষের মৃত্যু ইত্যাদি মাদার তেরেসার মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তিনি আর্ত মানুষের সেবায় নিজেকে সরাসরি নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে লোরেটোর কালো গাউন ছেড়ে নীল পাড় সূতি সাদা শাড়ি পড়ে কলকাতার গরিবদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। কাছাকাছি সময়ে তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালের ৭ই অক্টোবর মাত্র ১৩ জন নিবেদিতপ্রাণ সদস্য নিয়ে তিনি কলকাতায় Missionaries of Charity নামে একটি সেবাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত পৃথিবীর ১২৩টি দেশে ৬১০টি সেবাকেন্দ্রে ৪ হাজারের অধিক নান, ৩০০ জনের মতো ব্রাদার এবং ১ লক্ষাধিক স্বেচ্ছাসেবী সদস্য নিয়ে সেটি এক বিশাল সেবাকর্মে রূপ নেয়। একে-একে প্রতিষ্ঠা পায় বিভিন্ন নামে সেবাকেন্দ্র, যেমন নির্মল হৃদয়, শিশু ভবন, চিকিৎসালয়, আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও বাঙালিদের বিপুল বিজয় অর্জিত হওয়ার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ঐ বিজয় নস্যাৎ ও বাঙালিদের চিরতরে পদানত করে রাখতে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা ২৫শে মার্চ ১৯৭১ অপারেশন সার্চলাইট নামে নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় ৯ মাসব্যাপী পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর। গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, ঘরবাড়ি ধ্বংস, নারীর ওপর পাশবিক আচরণসহ অত্যাচার-নির্যাতনের এক বিভীষিকাময় জীবন। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক নির্বিশেষে দলে-দলে জীবন বিপন্ন মানুষ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বাংলাদেশের প্রায় এক-সপ্তমাংশ (১ কোটি) মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে গড়ে ওঠে শরণার্থী শিবির। কিন্তু তাতে ঠাঁই না হওয়ায় বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নেয়। কেউ-কেউ বড়বড় সুয়ারেজ পাইপের ভেতর আশ্রয় নেয়। শরণার্থীদের মধ্যে দেখা দেয় খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, ঔষধ ও স্যানিটেশনের প্রকট সমস্যা। জুন-জুলাই মাসে একদিকে বন্যা-বৃষ্টি, অপরদিকে মহামারী আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে প্রতিদিন অগনিত নারী, শিশু ও বৃদ্ধের মৃত্যু ঘটে।
এমনি অবস্থায় মাদার তেরেসা তাঁর মিশনারিস অব চ্যারিটির সেবকদের নিয়ে শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করেন; ছুটে যান এক শরণার্থী শিবির থেকে অন্য শিবিরে। দুঃস্থ, রোগাক্রান্ত ও শিশুদের জন্য সেবাকেন্দ্র স্থাপন করে তাদের সেবা-শুশ্রূষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। আগস্ট মাসে মার্কিন সিনেটের জুডিশিয়াল রিফিউজি সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি- ভারতে বাঙালি শরণার্থী ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শনে এলে মাদার তেরেসা ও তিনি শরণার্থীদের হাসপাতালে দুঃস্থদের দেখতে যান। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অন্তত ৬ মাস মাদার তেরেসা তাঁর চ্যারিটি সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতাসহ নানা সেবামূলক কার্য চালিয়ে যান। এক্ষেত্রে অক্সফাম প্রকাশিত The Testimony of Sixty ডকুমেন্টে তাঁর বক্তব্য ছিল মর্মস্পর্শী ও খবুই আবেদন সৃষ্টিকারী। তিনি বাঙালি শরণার্থীদের আশ্রয়দান ও খাদ্য সরবরাহের জন্য ভারত ও সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘পাকিস্তানের জনগণ (অর্থাৎ বাঙালি শরণার্থী), ভারতের জনগণ, ভিয়েতনামের জনগণ সব দেশের মানুষ, তারা যেখানকারই হোক-না-কেন, একই স্রষ্টার সৃষ্টি।’ শরণার্থী বিশেষ করে শিশুদের অবস্থা বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘লক্ষ লক্ষ শিশু অভুক্ত থাকছে ও পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। এছাড়া আরো অনেক সমস্যা রয়েছে, যা এতটাই প্রকট যে, চোখে না দেখলে বুঝা বা উপলব্ধি করা যাবে না।’ এরপর তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “বিশ্ব সম্প্রদায় যদি প্রয়োজনীয় খাদ্য, প্রোটিন ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিস নিয়ে দ্রুত এগিয়ে না আসে, তাহলে ঐসব শিশুদের ভাগ্য হবে নিশ্চিত মৃত্যু এবং তাদের এ মৃত্যুর জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কেই জবাব দিতে হবে।’ বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি জরুরি সাহায্যের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ৬ মাস ধরে শরণার্থীদের মাঝে কাজ করছি। আমি দেখেছি কীভাবে শিশু ও অন্যান্যরা মারা যাচ্ছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সার্বিক পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।’ বাঙালি শরণার্থী সমস্যা এককভাবে ভারতের নয়- এ কথা উল্লেখপূর্বক মাদার তেরেসা তাঁর বক্তব্য এভাবে শেষ করেন, ‘The appeal is to the world and the world must answer.’
মুক্তিযুদ্ধকালে অনেক নারীকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের বাংকার বা বন্দিশালায় রেখে তাদের ওপর মাসের পর মাস পাশবিক নির্যাতন চালায়। এভাবে কয়েক লক্ষ মা- বোন নির্যাতনের শিকার হন। জন্ম নেয় বহু যুদ্ধশিশু। মুক্তিযুদ্ধ শেষে পুরাতন ঢাকার ২৬ নম্বর ইসলামপুরে অবস্থিত মাদার তেরেসার ‘মিশনারিস অব চ্যারিটি’ কেন্দ্রে অসহায় শিশু, যুদ্ধশিশু ও নির্যাতিতা নারীদের আশ্রয় দান, পরিচর্যা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। অনেক নারী সেখানে সন্তান প্রসব করে। পরবর্তীতে যুদ্ধশিশুদের অনেককে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স ও সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশের আগ্রহী নাগরিকদের কাছে দত্তক দেয়া হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তীতে জীবনবিপন্ন, দুঃস্থ, অসহায় বাঙালি নারী, শিশু, বৃদ্ধদের মাঝে ত্রাণতৎপরতা, ঔষধ ও নার্সিং সেবা প্রদান এবং অনেককে পুনর্বাসনে সহায়তা করার মাধ্যমে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মাদার তেরেসা-কে Friends of Liberation War সম্মাননা (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়।
বিশ্বব্যাপী দুঃস্থ ও মানবতার সেবা এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭৯ সালে মাদার তেরেসা-কে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয় ১৯৮০ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারতরত্ন’ লাভ করেন। ১৯৯৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় ৮৭ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগI করেন। ২০১৬ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে পোপ ফ্রান্সিস মাদার তেরেসা-কে ‘সেন্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!