You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মাদারগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর)

মাদারগঞ্জ উপজেলা (জামালপুর) ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ বিজয় ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব সারা দেশের মতো মাদারগঞ্জ উপজেলায়ও পড়ে। জাতীয় ঘটনাপ্রবাহে প্রভাব বিস্তারকারী প্রতিটি আন্দোলনেই এখানকার জনগণ সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক ভাষণে তারা স্বাধীনতার মি. স্বপ্নে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে একটি সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকেই মাদারগঞ্জ উপজেলার দেশপ্রেমিক জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। শেরপুরের আসাদুজ্জামান খান এমএনএ, মাদারগঞ্জের করিমুজ্জামান তালুকদার এমএনএ, শফিকুল ইসলাম খোকা প্রমুখের উপস্থিতিতে ২৬শে মার্চ শ্যামগঞ্জ কালিবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাদারগঞ্জ উপজেলার দুশতাধিক মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জ, তুরা, তেলঢালা, ঢালু এবং কালাইপুর যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
দেশের অভ্যন্তরেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের পরামর্শে কয়েকজন আনসার সদস্য নিজ-নিজ এলাকার তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া মাদারগঞ্জের অন্যান্য স্থানেও প্রশিক্ষণ চলে। সানাইবান্দা মাদ্রাসা মাঠে প্রশিক্ষণ দেন পল্লীনগর গ্রামের আফতাব উদ্দিন আহমেদ দুলা বিএসসি (তাঁর নিজের একটি শর্টগান ছিল), হেমরাবাড়ী গ্রামের মো. আজিজল হক আইজল এবং আদারভিটা গ্রামের মো. কাজিম উদ্দিন মাস্টার। শ্যামগঞ্জ (কালিবাড়ী) উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ দেন ডা. আবুল খায়ের মিয়া। পাটাদহ কয়ড়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ দেন হে ই ম হেলাল (মুজিব বাহিনী-র সদস্য)। এছাড়া মাদারগঞ্জের ওসি মার্ক থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে মাঝে-মধ্যে মাদারগঞ্জ আশেক মাহমুদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ দিতেন। বাঁশের লাঠি বন্দুকের মতো ধরে পজিশন গ্রহণ, ক্রলিং, কমান্ডিং ইত্যাদি ছিল প্রশিক্ষণের অংশ। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচন, তাদের ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং আর্থিক সহযোগিতা দান করা হতো। উত্তর মাদারগঞ্জের মো. করিমুজ্জামান তালুকদার এমএনএ এবং দক্ষিণ মাদারগঞ্জের ডা. সৈয়দুজ্জামানের নেতৃত্বে এসব কর্মতৎপরতা চলত। এছাড়া আফতাব উদ্দিন আহমেদ দুলা বিএসসি ও মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
জামালপুর সদর মাদারগঞ্জ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- মো. করিমুজ্জামান তালুকদার এমএনএ, ডা. সৈয়দুজ্জামান (গুনারীতলা), শামছুল হক দুদু মিয়া (বীর ভাটিয়ান), এম এম শাহজাদা বুলবুল, মলয় কুমার কাঞ্জিলাল (শ্যামগঞ্জ), শমসের আলী মোল্লা (নলকা), মো. আফতাব উদ্দিন আহমেদ দুলা বিএসসি (নগর), মো. জালাল উদ্দিন (দুধিয়াগাছা), মো. মোয়াজ্জেম হোসেন (নগর), মো. আলতাফ হোসেন (মোসলেমাবাদ), এ কে আজাদ (জোড়খালি), মো. তাহেরুল ইসলাম ( মোসলেমাবাদ; স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি, পরে রাজাকার কর্তৃক নিহত), মো. আতোয়ার রহমান চান (চরনগর), নজরুল ইসলাম তালুকদার (মাদারগঞ্জ), আশরাফ তালুকদার (মাদারগঞ্জ), জিল্লুর রহমান সাদী (বালিজুড়ি), মো. আলাউদ্দিন বিএসসি (শ্যামগঞ্জ) প্রমুখ। এ কে আজাদ এবং মুজিব বাহিনীর সদস্য হে ই ম হেলাল কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
মাদারগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনীর প্রথম অনুপ্রবেশ ঘটে ২৪শে এপ্রিল। তারা পশ্চিম দিক দিয়ে স্টিমারে করে যমুনা নদী দিয়ে এখানে আসে। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধাদের নিক্ষিপ্ত গোলায় দুজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে এদিনই তারা মাদারগঞ্জ ছেড়ে চলে যায়। চারদিক নদীবেষ্টিত হওয়ায় এখানে যাতায়াত সহজ ছিল না। ফলে পাকবাহিনী এখানে কোনো স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেনি।
মাদারগঞ্জে পাকবাহিনীর সহযোগী শান্তি কমিটি, আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। শান্তি কমিটির অধিকাংশ নেতা থাকত জামালপুরে। তাদের প্রধান আস্তানা ছিল বাবুল গেস্ট হাউস। উপজেলার ৬নং আদারভিটা ইউনিয়নের শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল মো. ইসমাইল হোসেন এবং ৭ নং সিধুলি ইউনিয়নের সভাপতি ছিল মমতাজ উদ্দিন সরকার। রাজাকারদের মধ্যে আ. রশিদ ও আলবদর বাহিনীর মধ্যে আফছার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডে খুবই সক্রিয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হলো- মো. দেলোয়ার হোসেন চেয়ারম্যান (উত্তর জোড়খালী), মো. আলতাফুর রহমান তালুকদার (চাঁদপুর) এবং মো. রমিজ উদ্দিন মৌলানা (মোসলেমাবাদ)। পাকবাহিনীর জামালপুরস্থ পিটিআই ক্যাম্পে যোগাযোগ ও সংবাদ আদান-প্রদান এবং বিভিন্ন অভিযানের পরিকল্পনায় সহযোগিতা করা ছিল এদের কাজ। হানাদার বাহিনী মাদারগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে যে তিনবার আক্রমণ করেছে, তার প্রতিবারই পথ দেখিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের বাড়িঘর চিনিয়ে দিয়েছে স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা।
পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় চর ভাটিয়ানী গ্রামের বকস মন্ডলের বাড়ি, চর লোটাবর গ্রামের ওয়াজেদ আলী মাস্টার (চান মাস্টার) ও মো. আতাউর রহমান চেয়ারম্যানের বাড়ি, নগর গ্রামের হায়াত সরকার, তাহের সরকার, মোয়াজ্জেম হোসেন, আবদুস সাত্তার সরকার (ছাত্তার বাবু), তজ মণ্ডল, কবীর মণ্ডল, আনছার মণ্ডল, শাহজাহান মেকার, খলিলুর রহমান, ক্ষিতীশ চন্দ্ৰ সাহা, মতি মাস্টার ও অধীর সাহার বাড়ি, আদারভিটা গ্রামের মো. আব্বাস মণ্ডলের বাড়ি এবং আতামারী চর ও গাবের গ্রামের – বেশকিছু বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা মাদারগঞ্জের ৬নং স্ব আদারভিটা ও ৭নং সিধুলি ইউনিয়নে ২৫শে অক্টোবর গণহত্যা চালিয়ে অনেক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, যা ট আদারভিটা গণহত্যা ও সিধুলি গণহত্যা নামে পরিচিত। সহোদর তিন ভাই কাজিম উদ্দিন, আলিম উদ্দিন ও নাজিম উদ্দিন (মইরে মণ্ডল) এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দানকারী আনসার মো. মুনছের আলী ও কালু মণ্ডলকে বীর ভাটিয়ান গ্রামের শামছুল হক দুদু চেয়ারম্যানের চাচা এক ন রশিতে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। নলকা গ্রামে হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হন দুজন কৃষক আ. হামিদ (নলকা কামারবাড়ী) ও শমসের আলী। নগর গ্রামে গুলিবিদ্ধ হন মো. আবদুস সোবহান, ভোলা ও মিনু মণ্ডল। পাকবাহিনীর গুলিতে নিহত হন সহোদর তিন ভাই আব্দুল গনি, আব্দুল কদ্দুছ ও নূর হোসেন (পিতা মহির উদ্দিন) এবং আরো দুই সহোদর ঘুতা ও মেছের (পিতা রিয়াজ উদ্দিন)। নলকা গ্রামের জসিম উদ্দিনের পুত্র বাগুকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের অনেকের স্থান হয় গণকরবে। এ হত্যাকাণ্ড ও গণকবর আদারভিটা-নগর গ্রাম গণহত্যা ও গণকবর নামে পরিচিত।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হেমরাবাড়ী গ্রামের মো. আবুল কাশেম ডিলার, আদারভিটা গ্রামের মো. আলতাফ হোসেন (আলতা সুতার), মো. এজিবর রহমান, মো. নজরুল। ইসলাম মোল্লা, মো. ময়েন উদ্দিন মণ্ডল, মো. নওশের মণ্ডল (পিতা বিষর মাহমুদ), গয়েশ মণ্ডল (পিতা বাবুল্যা শেখ) ও মো. হোসেন আলীসহ ১০-১২ জন লোককে বেদম প্রহার করে। মো. আবুল কাশেম ডিলার ও মো. আলতাফ হোসেনকে কোমর পর্যন্ত গর্তের মধ্যে পুতে অবর্ণনীয় নির্যাতন করে। আদারভিটা ইউনিয়নের শান্তি কমিটির প্রধান মো. ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে ৪ জন যুবতি নারীকে ধরে এনে নির্যাতন করা হয়।
মাদারগঞ্জ উপজেলায় একটি বড় যুদ্ধ ও একটি অপারেশন পরিচালিত হয় – পয়লা ব্রিজ যুদ্ধ ও বাউশি ব্রিজ অপারেশন। ৩১শে অক্টোবর সকালে পয়লা গ্রাম যুদ্ধে ৩২ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং রমিজ উদ্দিন ও গোলাপ হোসেন নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। কমান্ডার এ কে আজাদের নেতৃত্বে ৪৪ জন মুক্তিযোদ্ধা বাউশি ব্রিজ অপারেশন করেন। এতে পাকবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। এ অপারেশনে ৪ জন মুক্তিসেনা শহীদ হন। ১২ই ডিসেম্বর মাদারগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- মো. শাহজাহান আলী, বীর বিক্রম (পিতা নাম জসীমউদ্দিন সরকার, চরভাটিয়ালি)।
মাদারগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- শাহজাহান আলী, বীর বিক্রম (নালিতাবাড়ী উপজেলার নয়াবিলে শহীদ), সাহেব আলী (কুকুরমারী; ঐ), রমিজ উদ্দিন (বিনোদ টংগী; মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুরে পয়লা ব্রিজ যুদ্ধে শহীদ), গোলাপ হোসেন (জোনাইল; ঐ) এবং শাহজাহান (জোনাইল নয়াপাড়া; বকশীগঞ্জ উপজেলার কামালপুরে শহীদ)।
এ উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে উপজেলা পরিষদ ভবনের সামনে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া শহীদ রমিজ উদ্দিন ও শহীদ গোলাপ হোসেনের নামে দুটি সড়ক এবং শহীদ শাহজাহান আলী, বীর বিক্রম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবুর নামে দুটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়েছে। [মো. রফিকুল ইসলাম ইরফান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!