You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.17 | মাদারগঞ্জ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মাদারগঞ্জ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর)

মাদারগঞ্জ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর) সংঘটিত হয় ১৭ই এপ্রিল। এতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অপরপক্ষে ২১ জন পাকসেনা নিহত হয়।
পীরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে ৮ কিমি পূর্বে এবং গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ১৫ কিমি পশ্চিমে মাদারগঞ্জ মফস্বল শহর অবস্থিত। মূলত ব্যবসায়িক শহর হিসেবে এটি সমধিক পরিচিত। ১৬ই এপ্রিল রংপুর-বগুড়া মহাসড়কে আংড়ার ব্রীজ যুদ্ধএ পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে সকলের ধারণা ছিল যে, পাকবাহিনী শক্তিবৃদ্ধি করে আবার আক্রমণ চালাবে। এমতাবস্থায় কমান্ডার আফতাব আলী সুবেদার সকল প্রতিরোধ যোদ্ধাকে নিয়ে মাদারগঞ্জ বন্দরে অবস্থান নেন এবং পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধকল্পে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নলেয়া খালের ওপর নির্মিত সেতুর দুপাশ কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। রংপুর, বগুড়া কিংবা দিনাজপুর থেকে পাকবাহিনী যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য মাদারগঞ্জে এ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেয়া হয়। এর ফলে পাকবাহিনী চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের প্রবেশ ঠেকাতে ব্যারিকেড তৈরিতে নেতৃত্ব দেন আফতাব আলী ওরফে আলতাফ সুবেদার এবং হাবিলদার মনসুর। মাদারগঞ্জ প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা মীরপুর এলাকায় অবস্থান নেন। স্থানীয় চৌধুরী বাড়ি থেকে যোগীবাড়ি পর্যন্ত এলাকায় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ, আলতাফ সুবেদারের বাহিনী, হাবিলদার মনসুরের বাহিনী এবং গাইবান্ধায় প্রশিক্ষণরত ৭২ জন মুক্তিযোদ্ধা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকবাহিনী তাদের দালাল এবং দোসরদের মাধ্যমে আংড়ার ব্রিজে প্রতিরোধযোদ্ধাদের অবস্থান জেনে ১৬ই এপ্রিল গভীর রাতে ব্যাপক গোলা-বারুদ ও মর্টার-কামান সজ্জিত সাঁজোয়া যানসহ বিপুল সেনা নিয়ে মাদারগঞ্জ বন্দরে প্রবেশ করে মাদ্রাসার পার্শ্বে অবস্থান নেয়। ১৭ই এপ্রিল ভোর হতে-না- হতেই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও প্রতিরোধযোদ্ধারা তার পাল্টা জবাব দেন। উভয় পক্ষ রাইফেল, মেশিনগান, স্টেনগানসহ ভারী অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মুহুর্মুহু গর্জনে এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মুক্তিবাহিনী ও প্রতিরোধযোদ্ধারা পূর্ব প্রান্তে সাদুল্যাপুর শশ্মানঘাট এলাকায় এবং পাকবাহিনী পশ্চিম প্রান্তে মাদারগঞ্জ স্কুল ও মাদ্রাসা এলাকায় অবস্থান নেয়। মাঝখানে মাদারগঞ্জ বন্দর। বন্দরের অধিকাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মুক্তিবাহিনীর কৌশলী আক্রমণে পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনী ও প্রতিরোধযোদ্ধারা এক সময় পিছু হটে বিভিন্ন স্থানে নতুন করে ব্যারিকেড তৈরি করেন। পাক হানাদার দল প্রতিরোধযোদ্ধাদের কৌশলগত এ পশ্চাদপসরণকে পরাজয় মনে করে বিজয় উৎসব করতে- করতে মাদারগঞ্জ বন্দরের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় বন্দরের মূল অংশ। একটানা সাড়ে ৯ ঘণ্টার যুদ্ধে ঘটনাস্থলে শহীদ হন শিরিস চন্দ্র সাহা ও হাকিম উদ্দিন শেখ এবং আহত হন অনেকে। আহতদের মধ্যে একজন ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আমিন। মারাত্মকভাবে আহত তাঁকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হলে পাকবাহিনীর সদস্যরা তাঁকে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় হত্যা করে। সে- সময় পাকিস্থানপন্থী কিছু লোক বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার বিপক্ষে এলাকায় মিছিল করে আতঙ্ক ছড়ায় এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ও মালামাল লুণ্ঠনে সমর্থন জানায়। এ-যুদ্ধে ২১ জন পাকসেনা নিহত হয়।
ইপিআর সদস্য আফতাব সুবেদারের নেতৃত্বে প্রতিরোধযোদ্ধা ও মুক্তিবাহিনী মাদারগঞ্জ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এ-যুদ্ধে আরো যাঁরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন হাবিলদার মনসুর ও তাঁর সহযোগী এক প্লাটুন সৈন্য। গাইবান্ধার বিভিন্ন আঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক প্রতিরোধযোদ্ধারাও এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন- কোরবান আলী, ক্যাপ্টেন মাহাবুব, বয়েজ উদ্দিন, জিয়াউল হক জিয়া, আজিম উদ্দিন (আনসার ইন্সট্রাক্টর), মমতাজ আলী, আবুল কাশেম, কাজিউল ইসলাম, ওয়াহেদুজ্জামান তিতু, একরাম হোসেন বাদল, আবুল হোসেন (বোর্ড বাজার), আবুল কালাম (বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ঢাকা), সবুজ মিয়া মো. রফিকুল ইসলাম হিরু (বল্লম ঝাড়), আবুল কাশেম (টেংগরজানী) প্রমুখ।
মাদারগঞ্জ প্রতিরোধযুদ্ধের আগে এখানে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটির নেতৃবৃন্দ ছিলেন- আবু হোসেন সরকার, শাহ নুরুল হক চৌধুরী, অমূল্য রতন সাহা, জগদীশ চন্দ্র মহন্ত, আব্দুল কুদ্দুছ সরকার, মোহাম্মদ আলী মন্ডল, হাফিজার রহমান মন্ডল, মোকসেদুল হক চৌধুরী এবং হাফিজার রহমান সরকার। এছাড়া ঘরবাড়ি ত্যাগ করা লোকজনদের ফিরিয়ে আনার জন্য একটি রিসিপশন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন— আবু হোসেন সরকার, শাহ নুরুল হক চৌধুরী, অমূল্য রতন সাহা, অবুল কালাম আজাদ, আ. মমিন আকন্দ, আব্দুস সোবাহান বাদশা প্রমুখ। এঁরা অসহায় ও নিঃস্ব লোকজনদের সার্বিক সহায়তা প্রদান এবং এলাকায় লুটপাট ঠেকাতে সহযোগিতা করেন।
মাদারগঞ্জ যুদ্ধের ইতিহাস ও যুদ্ধের স্মৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। [লুৎফর রহমান সাজু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড