You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাদ্রার যুদ্ধ (ঝালকাঠি)

মাদ্রার যুদ্ধ (ঝালকাঠি) সংঘটিত হয় ৬ই মে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথমদিকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা কমরেড সিরাজ সিকদার ঝালকাঠি অঞ্চলে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাঁর ক্যাম্প ছিল ঝালকাঠি শহরের পালবাড়ী এলাকায়। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ঝালকাঠি কলেজের ছাত্র সেলিম শাহনেওয়াজ। তাঁর জন্মস্থান ছিল বরগুনা জেলার পাথরঘাটা থানায়। ২৭শে এপ্রিল পাকবাহিনীর হাতে ঝালকাঠি শহরের পতন ঘটলে এখানে আর ক্যাম্প রাখা সম্ভব ছিল না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্যাম্পটি কীর্তিপাশায় সরিয়ে নেয়া হয়। পাকবাহিনী কীর্তিপাশা আক্রমণ করলে সিরাজ সিকদার তাঁর বাহিনীকে কয়েক ভাগে ভাগ করে মাদ্রা, শতদশকাঠি, আতা ও ভীমরুলী গ্রামে পৃথক-পৃথক ক্যাম্প স্থাপন করেন। সিরাজ সিকদার এ সময় ‘সালাম’ ছদ্মনামে আতা ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। তাঁর দলে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন হুমায়ুন কবীর, রেজায়ে সাত্তার ফারুক, গিয়াস কবীর, মুজিবুল হক মেহেদী, বিপ্লব, আসাদ, ফারুক, মজিদ, আনোয়ার, ফকু, মিলু প্রমুখ।
পাকবাহিনী প্রায় প্রতিদিনই মাদ্রা অথবা বেত্রা হয়ে আটঘর- কুড়িয়ানায় অপারেশনে যেত। ৬ই মে একটি মাঝারি আকারের নৌযানে করে ৪৫ জন পাকসেনার একটি দল মাদ্রা আসে। সিরাজ সিকদারের বাহিনী এ খবর জানতে পেরে রেজায়ে সাত্তার ফারুকের নেতৃত্বে নৌযানটি আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের মধ্যে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুক্তিসেনাদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে পাক হানাদাররা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে সাতজন পাকসেনা নিহত এবং একজন বন্দি হয়। পরের দিন বন্দি পাকসেনাকে বাঁশে বিদ্ধ করে বাউকাঠি বাজার প্রদক্ষিণ করা হয়। এ ঘটনার কয়েক দিন পর পাঁচশতাধিক পাকসেনা ও রাজাকার ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে চারদিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে শুরু করে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নারীধর্ষণ। তারা পূর্বের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে। তাদের ধর্ষণের শিকার অনেক নারীকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে মায়ের সামনেই আছড়ে হত্যা করে। গণধর্ষণের পর সেই মাকেও হত্যা করে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলে তাদের এই পৈশাচিকতা। তারা নিহতদের অনেকের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এদিনের গণহত্যায় অনেক পরিবার আছে যাদের একজন সদস্যও জীবিত ছিল না।
মাদ্রা হত্যাকাণ্ডের শিকার ২৫ জনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন: তারাকান্ত মিস্ত্রী (শিক্ষক), স্বর্ণ কুমার মিস্ত্রী (গৃহস্থ), মনোরঞ্জন রায় (গৃহস্থ), শ্রীনাথ চন্দ্র রায় (কৃষক), সুরেশ চন্দ্র মণ্ডল (কৃষক), হরেন্দ্র নাথ মণ্ডল (কৃষক), নগেন্দ্র নাথ মিস্ত্রী (কৃষক), নির্মল চন্দ্র মিস্ত্রী (কৃষক), উপেন্দ্ৰ নাথ মণ্ডল (কৃষক), গোপল কৃষ্ণ ঘরামী (কৃষক), রতিকান্ত বেপারী (চাকরিজীবী), উপেন্দ্র নাথ বেপারী (কৃষক), সারদানাথ বেপারী (কৃষক), ললিত কুমার রায় (কৃষক), মনোরঞ্জন বেপারী (ছাত্র), নগেন্দ্র নাথ মণ্ডল (কৃষক), সুশীল কুমার মণ্ডল (গৃহস্থ), বসন্ত কুমার বালা (কৃষক), যোগেন্দ্ৰ নাথ হালদার (গৃহস্থ), সুখরঞ্জন মিস্ত্রী (ছাত্র), সুরেশ কুমার মণ্ডল (ব্যবসায়ী), রাখাল চন্দ্র রায় (গৃহস্থ), সুরেশ চন্দ্র মণ্ডল (শিক্ষক), কাশীশ্বর সিকদার (কৃষক) এবং জিতেন সিকদার (কৃষক)। এদের সবাই মাদ্রা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন না। অনেকেই অন্য স্থান থেকে এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নিভৃত পল্লির এসব এলাকা খুঁজে বের করা পাক হানাদারদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, এ দেশেরই মানবরূপী কতিপয় তাদের চিনিয়ে দিয়েছিল। [শ্যামল চন্দ্র সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!