You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাধপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (ঈশ্বরদী, পাবনা)

মাধপুর প্রতিরোধযুদ্ধ (ঈশ্বরদী, পাবনা) সংঘটিত হয় ২৯শে মার্চ। এতে ১৭ জন প্রতিরোধযোদ্ধা শহীদ ও ৩ জন গুরুতর আহত হন। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়।
১৯৭১ সালের ২৭ ও ২৮শে মার্চ পাবনার স্বাধীনতাকামী মানুষের হাতে শতাধিক পাকসেনা প্রাণ হারায়। ২৯শে মার্চ পাবনা ইপসিক নগরীতে (বর্তমান বিসিক) আহত ও আটকেপড়া সেনাদের উদ্ধারের জন্য পাকিস্তানি মেজর আসলামের নেতৃত্বে একদল পাকসেনা এখানকার সেনাক্যাম্পে আসে। মেজর আসলামের তত্ত্বাবধানে পাকসেনাদের ১১টি ট্রাকের বহর পাবনা থেকে হিমায়েতপুরের পথ ধরে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। ঐদিন ঈশ্বরদীর পাকশী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ – স্থানীয় রেলওয়ে ফুটবল মাঠে যৌথভাবে সমাবেশ ডাকে। সমাবেশে জনতার ঢল নামে। সবার হাতে ছিল লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র। কীভাবে পাকসেনাদের নতুন করে আগমন প্রতিহত করা যায় সে পরিকল্পনা করাই ছিল সমাবেশের প্রধান লক্ষ্য। সমাবেশের সিদ্ধান্ত অনুসারে পাকশীর চেয়ারম্যান ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন প্রতিরোধযোদ্ধা পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য মাধপুরের দিকে অগ্রসর হন। তাঁদের সঙ্গে হাজার-হাজার সাধারণ লোক তীর, ধনুক, বল্লম ও লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করে দুপুর নাগাদ মাধপুর এসে পৌছায়। পাকসেনারা তখনো মাধপুরে এসে পৌছায়নি। প্রতিরোধযোদ্ধারা অপেক্ষা করতে থাকেন। মাধপুরে কোনো ঝোপ-জঙ্গল না থাকায় ক্ষিপ্ত জনতা রাস্তার উভয় পাশে অবস্থান গ্রহণ করে। কেউ-কেউ গাছের আড়ালে, নিচু জায়গায়, পাশের বেগুনক্ষেত ও দূরবর্তী বাঁশঝাড়ের মধ্যে পজিশন নেয়। বেলা আড়াইটার দিকে পাকসেনাদের ট্রাকবহর মাধপুরে এসে পৌছায়। প্রত্যেক ট্রাকের সামনে মেশিনগান বসানো। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শুধু স্বাধীনতার নেশায় উজ্জীবিত প্রতিরোধযোদ্ধারা তাঁদের নেতা ইউসুফ আলীর নির্দেশে পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং কিছুটা পিছু হটে পজিশন নেয়। অতঃপর তারা মেশিনগান দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকবাহিনীর বেপরোয়া আক্রমণে প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্যরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাঁদের অস্ত্র বলতে ছিল ৬টি গাদা বন্দুক, ৩টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, ২টি টু-টু বোর রাইফেল, লাঠি, সড়কি ও রডের তৈরি কিছু বল্লম। রেললাইন থেকে সংগৃহীত পাথর নিয়েও অনেকে এ-যুদ্ধে অংশ নেন। বেশকিছু যুবকের কাছে ছিল হাতে তৈরি ককটেল। প্রতিরোধ বাহিনীর নেতা ইউসুফ আলীর সম্বল ছিল মাত্র একটি রিভলবার। তাঁদের সামান্য গোলাবারুদ নিমেষেই ফুরিয়ে যায়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। তরুণ প্রতিরোধযোদ্ধা ঈশ্বরদী সরকারি কলেজের (তখন জিন্নাহ কলেজ) ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান রাজু এবং ওহিদুল ইসলাম রাস্তার পাশে একটি বটগাছের গুঁড়ির আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাজুর হাতে ছিল ককটেল এবং ওহিদুলের হাতে ছিল বন্দুক। রাজু একটি ট্রাক লক্ষ করে ককটেল ছুড়ে মারলে তাতে আগুন ধরে যায়। পরক্ষণেই পাকসেনাদের বুলেটের আঘাতে রাজু ও ওহিদুলের বুক ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে এ প্রতিরোধযুদ্ধে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা হলেন- ইউসুফ আলী (প্রতিরোধ বাহিনীর প্রধান), ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান রাজু, ওহিদুল ইসলাম, কাজী সদরুল হক, জাফর সাজ্জাদ খিচু, আব্দুর রহিম টিনু, আব্দুর রাজ্জাক, নবাব আলী, আব্দুল গফুর, রবিউল আলম, টুকু, পান্না, চান্না, রানু, ইসাহাক, গাফফার প্রমুখ। মাধপুর প্রতিরোধযুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন- হাবিবুর রহমান রাজু (পিতা আব্দুর রহিম, রূপপুর), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা আমিন উদ্দিন, বিলকেদা), ওহিদুল ইসলাম (পিতা দিনু মিস্ত্রী, ঈশ্বরদী), আব্দুল গফুর (পিতা খোরশেদ আলী, পাকশী), নবাব আলী (পিতা গোকুল মণ্ডল, বাঘইল), নূরুল ইসলাম (পিতা নবীর উদ্দিন, চররূপপুর), তাজের উদ্দিন (পিতা দলু প্রামাণিক, জোতগাছি), নবীর উদ্দিন (পিতা চিনি প্রামাণিক, জোতগাছি), লস্কর সরদার (জোতগাছি), ফরমান সরদার (পিতা শীতল সরদার, মাধপুর) এবং হামির উদ্দিন (পিতা আরমান প্রামাণিক, মাধপুর)। গুরুতর আহত তিন জন হলেন- আজিজা খাতুন টুনু (পিতা ড. ওবাদুর রহমান, চকপৈলানপুর), মনোয়ার হোসেন আলোক (পিতা মকবুল হোসেন, চরমাধপুর) ও রহিমা খাতুন (পিতা শহীদুল্লাহ প্রামাণিক, মাধপুর)।
এ-যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। মাধপুর ত্যাগ করার আগে পাকসেনারা গোটা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে অসংখ্য নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। মাধপুরের কানু মোল্লা, জামাল, জাকের ও প্রাক্তন পুলিশ সদস্য মহিউদ্দিনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে। বাংলাদেশের মক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মাধপুর প্রতিরোধ যুদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ছিল একটি অসম যুদ্ধ। শুধুমাত্র সাহস ও মনোবল নিয়ে কীভাবে বাঙালিরা পাকবাহিনীর মতো প্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, এটি তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। মাধপুরের বটতলায় প্রতিরোধযুদ্ধ ও তাতে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [মো. ছাবেদ আলী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!