মাদরা ক্যাম্প যুদ্ধ (কলারোয়া, সাতক্ষীরা)
মাদরা ক্যাম্প যুদ্ধ (কলারোয়া, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ৯ই নভেম্বর। এতে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ৭-৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পরাজিত পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। মাদরা স্থানটির অবস্থান সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নে। সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই এখানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পের পাকসেনারা অত্র এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ এলাকাটি ছিল ৮নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এখানকার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী (চুয়াডাঙ্গার এসডিও মুক্তিযুদ্ধকালে র্যাংক ‘ক্যাপ্টেন’), ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমেদ (এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধকালে র্যাংক ‘ক্যাপ্টেন’) ও ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ। এঁরা পরিকল্পনা করেন যে, অতর্কিতে আক্রমণ করে মাদরা ক্যাম্পের পাকসেনাদের উৎখাত করতে হবে।
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীদের অধীনে বহু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রথম ভাগটিকে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহর নেতৃত্বে মাদরা ক্যাম্পে আক্রমণ চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলেম উদ্দীনের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ জনের একটি দলকে পাঠানো হয় কোটা গ্রামের বাগাআঁচড়া-সোনাবাড়িয়া রাস্তায় অবস্থান নেয়ার জন্য। এ রাস্তা দিয়ে বাগাআঁচড়ায় অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প থেকে মাদরা ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছন্ন করার জন্য কোটার ভেতরে ধানতাড়া নামক স্থানে মোসলেম উদ্দীন তাঁর বাহিনী নিয়ে অবস্থান নেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল ৪টি এলএমজি, ২টি রাইফেল ও গ্রেনেড। চল্লিশ জনের অপর একটি দলকে কমান্ডার আব্দুল গফফারের নেতৃত্বে কলারোয়া-কোমরপুর রাস্তা বন্ধের দায়িত্ব দেয়া হয়, যাতে মাদরা ক্যাম্প আক্রমণ করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা বাইরে থেকে সাহায্য না পায়।
ঘটনার দিন ভোর ৫টার দিকে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহর নেতৃত্বে মাদরা ক্যাম্পে আক্রমণ চালানো হয়। ইতিমধ্যে মাদরা ক্যাম্পের পাকসেনাদের সহযোগিতার জন্য বাগাআঁচড়া থেকে পাকসেনারা রওনা হয়। পথিমধ্যে কোটায় অবস্থানরত মোসলেম উদ্দীনের বাহিনী তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। কমান্ডার মোসলেম উদ্দীনের এলএমজির মুহুর্মুহু গুলিতে পাকবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটতে থাকে। এখানে ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়, বাকিরা বাগাআঁচড়া ক্যাম্পে ফিরে যায়।
মাদরা ক্যাম্প আক্রমণে ইপিআর-এর নায়েক সুবেদার ইলিয়াস পাটোয়ারী ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রাখেন। পাকবাহিনীর সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ হয়। মাদরা ক্যাম্পটি ছিল ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। ভারী কামান দ্বারা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। সে তুলনায় মুক্তিবাহিনীর কম এবং হালকা অস্ত্র থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা সুবিধা করতে পরছিলেন না। তবুও তাঁরা প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ক্যাপ্টেন মাহবুব আহত হন। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহও আহত হলে মুক্তিযোদ্ধারা কিছুটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েন। কিন্তু পরক্ষণে তাঁরা গেরিলা আক্রমণে পাকবাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হন। পাকবাহিনী মাদরা ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে ৭-৮ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
যে-সকল মুক্তিযোদ্ধা মাদরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন- ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ (কুমিল্লা), ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমেদ, কমান্ডার আব্দুল গফফার (বহুড়া), কমান্ডার মোসলেম উদ্দীন (তুলসীডাঙ্গা), এ জেড নজরুল ইসলাম (বোয়ালিয়া), রেজাউল হক (বোয়ালিয়া), আয়ুব আলী (বোয়ালিয়া), জাহাঙ্গীর আলম (মদনপুর), আব্দুর রউফ (কয়লা), চিত্ররঞ্জন (কেড়াগাছি), আশরাফ আলী (কেড়াগাছি), নুরুল ইসলাম (মুরারিকাঠি), আবুল হোসেন (পারিখুপী), বজলু (বাঘারপাড়া, যশোর), গিয়াসউদ্দীন (ঝিনাইদহ), ছাফার উদ্দীন (বালিয়ানপুর), ওজিয়ার রহমান (বলিয়ানপুর), কার্তিক চন্দ্র সরকার (বোয়ালিয়া) প্রমুখ। [মাসুদুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড