You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ মাইকেল বার্নস

মাইকেল বার্নস (১৯৩২-২০১৮) ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, লেবার পার্টির এমপি, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বাংলাদেশের একনিষ্ঠ সমর্থক, সাবেক মন্ত্রী জন স্টোনহাউজ-কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কিছু এমপি-কে নিয়ে গঠিত অত্যন্ত সক্রিয় ও শক্তিশালী একটি গ্রুপের অন্যতম সদস্য, Bangladesh Freedom Movement Overseas-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান (মে ১৯৭১), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত। ১৯৩২ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। তাঁর পূর্ণ নাম মাইকেল সিসিল জন বার্নস। তিনি ১৯৬৬ সালে লেবার পার্টি থেকে ব্রেন্টফোর্ড ও সিজউইক নির্বাচনী এলাকা থেকে সর্বপ্রথম পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পূর্ব বাংলায় অপারেশন সার্চলাইট- নামে পাকিস্তানি বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরুর কয়েক দিনের মধ্যেই (৪ঠা এপ্রিল) লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড টাউন হলে একটি সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে মাইকেল বার্নসও বক্তৃতা করেন। এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের ক্রিকেট টিম যুক্তরাজ্য সফরে আসে। তাদের এ সফর ও খেলা বাতিল করার দাবি জানিয়ে মাইকেল বার্নস ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব আনেন এবং তাঁর ঐ প্রস্তাবের সমর্থনে পার্লামেন্টের আরো ৩০ জন সদস্য স্বাক্ষর দান করেন। মে মাসে ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন War on Want-এর চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ-এর নেতৃত্বে তাঁরা ৪ সদস্যের একটি টিম ভারতের বাঙালি শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসেন। তাঁরা পশ্চিম বাংলা ও আগরতলায় একাধিক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। সে-সময় তাঁরা সীমান্তের অভ্যন্তরে বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ- ও সরকারের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। একই সময় আগরতলায় মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী-র সঙ্গেও তাঁদের সাক্ষাৎ হয়। যুক্তরাজ্যে ফিরে মাইকেল বার্নস পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে এবং বাইরে শরণার্থীদের করুণ অবস্থা ও বাংলাদেশের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্বন্ধে তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন, যা ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে জনমত গঠনে খুবই সহায়ক হয়। মে মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ৩০০ এমপি-র স্বাক্ষরে পার্লামেন্ট সদস্য ব্রুস ডগলাস-ম্যান- কর্তৃক পূর্ব বাংলায় যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানিয়ে যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং জুন মাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির দাবি করে ২১৬ জন ব্রিটিশ এমপি-র স্বাক্ষরযুক্ত যে প্রস্তাব পার্লামেন্টে পেশ করা হয়, তার উভয়টিতে মাইকেল বার্নস অন্যতম স্বাক্ষরকারী ছিলেন। ব্রুস ডগলাস-ম্যান উত্থাপিত প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে পার্লামেন্টে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন (বঙ্গানুবাদ), ‘পাকিস্তান হাইকমিশন লন্ডনে যেসব বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তাঁদের সমবন্ধে ব্রিটিশ সরকারের মাধ্যমে খবরাখবর নেয়ার চেষ্টা করছেন। কোনো অবস্থাতেই যেন ব্রিটিশ সরকার এসব বাঙালির সম্বন্ধে পাকিস্তান সরকারকে কোনো তথ্য সরবরাহ না করেন।’ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর শেষে ২রা জুন লন্ডনে এসে পৌঁছালে ৪ঠা জুন একশন বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে পল কনেট ও মেরিয়েটা প্রকোপ- লন্ডনে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতির আহ্বান জানান। একই অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে মাইকেল বার্নসও বক্তৃতা করেন।
আগস্ট মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি অবস্থায় সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার শুরু হলে ১১ই আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে প্রবাসী বাঙালিদের এক বিরাট প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনমূলক বিচার বন্ধ ও তাঁর অনতিবিলম্বে মুক্তির দাবিসম্বলিত প্লাকার্ড হাতে শোভাযাত্রা সহকারে শতশত লোক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট ভবনে স্মারকলিপি পেশ করে। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, জন স্টোনহাউজ, পিটার শোর প্রমুখের সঙ্গে মাইকেল বার্নস শোভাযাত্রার অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বাঙালি শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনসহ বাংলাদেশ সংকটের একমাত্র সমাধান সে দেশের স্বাধীনতা। তাঁর এ অভিমত তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং এর বাইরে বিভিন্ন ফোরাম ও সভা-সমাবেশে বিভিন্ন সময়ে অতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। মাইকেল বার্নস বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠিত British-Bangla-Parliamentary Group-এর ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর ১৯৮২ সালে লন্ডনে প্রবাসী বাঙালিদের উদ্যোগে সর্ব ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হলে তিনি এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। বিখ্যাত আইনজীবী শন ম্যাকব্রাইড- ছিলেন এর প্রতিষ্ঠিতা প্রেসিডেন্ট।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মাইকেল বার্নস-কে Friends of Liberation War সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। ২০১৮ সালের ২২শে মার্চ ৮৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের একনিষ্ঠ বন্ধু মাইকেল বার্নসের জীবনাবসান ঘটে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: আবদুল মতিন, স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালী, লন্ডন, র্যাডিকেল এশিয়া পাবলিকেশন্স ১৯৮৯; আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, ঢাকা, ইউপিএল ১৯৯০; শেখ আবদুল মান্নান, মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্যের বাঙালীর অবদান, ঢাকা, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ১৯৯৮; Harun-or-Rashid, “British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971″, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4(2), 139-149; 15 https:// www.swadhinata.org.uk/wp-content/uploads/2017/10/Mr.-Michael-Barnes.docx

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!