You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাইজদী শহর অপারেশন (নোয়াখালী সদর)

মাইজদী শহর অপারেশন (নোয়াখালী সদর) পরিচালিত হয় ৭ই ডিসেম্বর। এতে বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয় এবং বহু রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে রাজাকারদের গুলিতে ৪ জন সাধারণ মানুষ প্রাণ হারান। এ অপারেশনের মধ্য দিয়ে মাইজদী শহর হানাদারমুক্ত হয়।
মাইজদী নোয়াখালী সদর উপজেলার প্রধান শহর এবং নোয়াখালী জেলার হেডকোয়ার্টার্স। মুক্তিযুদ্ধের সময় শহরের প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে (পিটিআই) পাকিস্তানি বাহিনী বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান ঘাঁটি স্থাপন করে। এখান থেকেই তারা তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহযোগিতায় সকল অভিযান পরিচালনা করত। ২৪শে এপ্রিল থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এখানে অবস্থান করে। ৫ই ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী-র আক্রমণে টিকতে না পেরে বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর ও ফেনী (বর্তমানে জেলা)-সহ বিভিন্ন স্থান থেকে তারা ক্যাম্প ত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে সড়ক ও রেলপথে কুমিল্লা সেনানিবাসে আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে নোয়াখালী জেলার বিভিন্ন স্থানের ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা মাইজদী পিটিআইতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ ক্যাম্প ছাড়াও রাজাকাররা সোনাপুর কোল্ড স্টোরেজ, দত্তেরহাট, মাইজদী রৌশনবানী সিনেমা হল, মাইজদী কোর্ট রেলওয়ে স্টেশন, লক্ষ্মীনারায়ণপুর নাহার বিল্ডিং ও মাইজদী বাজার ভোকেশনাল স্কুলে অবস্থান নেয়।
এদিকে ৫ই ডিসেম্বর বিকেল থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সকল বাহিনীকে একত্রিত করে বিএলএফ বাহিনীর জেলা কমান্ডার মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জোনাল কমান্ডারগণ দ্রুত মাইজদী শহর আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম নির্ধারণ করেন। মাইজদী পিটিআই আক্রমণের আগের দিন রাতে নোয়াখালী কলেজের ভিপি জয়নাল আবেদীন (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী)-এর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) ৬০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা লক্ষ্মীনারায়ণপুর গ্রামে হাজী আছমত উল্যা মসজিদ বাড়িতে (রেল লাইন সংলগ্ন পূর্ব পার্শ্বে) অবস্থান নেন। মাইজদী পিটিআই থেকে মসজিদ বাড়ির দূরত্ব এক কিলোমিটারের মতো।
মুক্তিযোদ্ধা রফিক উল্যাহ (পিতা বাদশা মিয়া, মুজাপুর) ও খায়ের আহম্মদ (লক্ষ্মীনারায়ণপুর)-কে নোয়াখালীর ডিসি মঞ্জুরুল করিমের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাঁরা রাত ৮টার দিকে ডিসিকে টেলিফোনে অপারেশনের পরিকল্পনা এবং এতে তাঁর নিরাপত্তা বাহিনী যেন কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে, সে বিষয়ে বলেন। ৬ই ডিসেম্বর রাত ৩টা (অর্থাৎ ৭ই ডিসেম্বর) থেকে মুক্তিযোদ্ধারা মাইজদী বাজার থেকে সোনাপুর পর্যন্ত ১২টি পথে আক্রমণ শুরু করেন। তাঁরা মাইজদী ভোকেশনাল স্কুল আক্রমণ করলে রাজাকাররা টিকতে না পেরে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সোনাপুর, দত্তেরহাট, রৌশনবানী সিনেমা হল ૭ লক্ষ্মীনারায়ণপুর নাহার ভবন ক্যাম্পের রাজাকাররা তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কাঞ্চন নামের একজন রাজাকারসহ কয়েকজন রাজাকার পালিয়ে যায়। অপরদিকে, মুজিব বাহিনীর প্রধান মাহমুদুর রহমান বেলায়েতের নির্দেশে মুজিব বাহিনী শহরের পূর্বদিকে অবস্থিত মাইজদী কোর্ট স্টেশনে অবস্থানরত রাজাকার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে ক্যাম্পের পতন ঘটায়। এরপর তাঁরা পাকবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি পিটিআই-এর দিকে এগুতে থাকেন। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং পুলিশ লাইনের ম্যাগাজিনের (বর্তমানে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার) সকল অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে বুঝিয়ে দেয়। এসব অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সি জোনের হেডকোয়ার্টার্সের ছাউনিতে রাখা হয়।
এদিকে পিটিআইতে অবস্থানরত রাজাকাররা পিটিআই-এর প্রশাসনিক ভবন এবং ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেলের দোতলা থেকে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। অপরদিকে, মুক্তিযোদ্ধারা পিটিআই-এর চতুর্দিক ঘেরাও করে পাল্টা গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট ভারী অস্ত্র না থাকায় ২ নম্বর সাব-সেক্টর কমান্ডার রাজনগর লে. কর্নেল জাফর ইমাম, বীর বিক্রমএর সহযোগিতায় ২ ইঞ্চি মর্টার গান এনে সন্ধ্যা ৬টার দিকে মাইজদী শহীদ ভুলু স্টেডিয়ামের উত্তর-পশ্চিম কর্নার থেকে পিটিআই রাজাকার হেডকোয়ার্টার্সের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ করলে বেশকিছু রাজাকার নিহত এবং বহু রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। কিছু রাজাকার পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। এ অপারেশনের মধ্য দিয়ে মাইজদী শহর হানাদারমুক্ত হয়। মাইজদী শহর অপারেশনে রাজাকার বাহিনীর গুলিতে নোয়াখালী কলেজের অধ্যাপক আবুল হাসেম, ছাত্র নজরুল ইসলাম স্বপন, সরকারি কর্মকর্তা আবদুল জলিল ও নাজির বসু মিয়া শহীদ হন। [মো. ফখরুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!