মাগুরা যুদ্ধ (তালা, সাতক্ষীরা)
মাগুরা যুদ্ধ (তালা, সাতক্ষীরা) সংঘটিত হয় ২৫শে নভেম্বর। এ-যুদ্ধে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও বেশ কয়েকজন আহত হন এবং একজন পাকসেনা নিহত হয়। কপোতাক্ষ নদের দক্ষিণ তীরে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার মাগুরা একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামে রয়েছে জয়ন্তি পীর (রহ.)-র দরগাহ। মাগুরা বাজার থেকে আধা কিলোমিটার ভেতরে অজয় কুমার রায়চৌধুরী (ঝুনু চৌধুরী) নামে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির বাড়িতে ছিল মুজিব বাহিনী-র অস্থায়ী ক্যাম্প। মাগুরা, বাতুয়াডাঙা, বালিয়াদহ, বারাত, মাদরা প্রভৃতি এলাকায় তালা ও সাতক্ষীরার মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অনেকটা নিরাপদে অবস্থান করতেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কামরুজ্জামান টুকু, খুলনা বি এল কলেজের ছাত্রনেতা ইউনুস আলি ইনু, ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবর রহমান, স ম আলাউদ্দীন, চেয়ারম্যান বি করিম, সুজায়েত মাস্টার, তালার আব্দুস সালাম মোড়ল, শেখ শামসুর রহমান, মকবুল হোসেন প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ এখানে বসে সাতক্ষীরা এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধের কলাকৌশল নিয়ে পরামর্শ করতেন। এক পর্যায়ে তালার মুক্তিবাহিনী (গেরিলা গ্রুপ) ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা যুক্ত হয়ে স্থানীয় রাজাকার ও নকশালদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এক সকালে অজয় কুমার রায়চৌধুরী কয়েকজন যুবককে নিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় পাটকেলঘাটা বাজারে রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। রাজাকাররা তাঁদের ওপর নির্মম নির্যাতন করে জানতে পারে যে, মাগুরায় অজয় কুমার রায়চৌধুরীর বাড়িসহ আশপাশের বাড়িতে বহু মুক্তিযোদ্ধা ব্যাপক গোলাবারুদ নিয়ে অবস্থান করছেন। এ তথ্য পাওয়ার পর রাজাকাররা তাঁদের হত্যা করে।
২৫শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মাগুরা ও আশপাশের গ্রামে অবস্থান করছিলেন। কেউ-কেউ দুপুরের খাবার খেয়েছেন, অন্যরা খেতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কমান্ডার পর্যায়ের দু-একজন মুক্তিযোদ্ধা পরদিন পার্শ্ববর্তী খুলনা জেলার কপিলমুনি বাজারে অবস্থিত রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা করছিলেন। তাঁদের কাছে তখন তেমন ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। সেগুলো নিরাপত্তার কারণে এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে রাখা হয়েছিল। এ-সময় নয় নম্বর সেক্টরের সাব-কমান্ডার ক্যাপ্টেন সফিকউল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবর রহমান, স ম আলাউদ্দীন, ইউনুস আলি ইনু, শেখ শামসুর রহমান, সুজায়েত মাস্টার, আব্দুস সালাম মোড়ল, চেয়ারম্যান বি করিমসহ বহু মুক্তিযোদ্ধা মাগুরা গ্রামে অবস্থান করছিলেন। ঠিক তখন মাগুরা পোস্ট অফিসের পিয়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার আব্দুল জব্বার এসে জানান যে, পাটকেলঘাটা থেকে পাকবাহিনী রাজাকারদের নিয়ে মাগুরা মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। এ খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। গ্রামের মানুষজনও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে। নেতা- সংগঠকগণ বিচলিত হয়ে ওঠেন। এমন পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয় যে, সুভাষ সরকারের নেতৃত্বে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকবাহিনী ও রাজাকারদের প্রতিরোধ করবেন এবং অন্য মুক্তিযোদ্ধারা গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কপিলমুনির দিকে চলে যাবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এদিকে এক ট্রাক পাকসেনা ও রাজাকার গুলি ছুড়তে-ছুড়তে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসে। তৎক্ষণাৎ সুভাষ সরকারের নেতৃত্বে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা মাগুরা গ্রামের ক্ষত্রিয়পাড়ার পূর্বপাশে অবস্থান নেন এবং শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করেন। ফলে, দু-পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা শেখ নুরুজ্জামান মন্টু (পিতা শেখ শাহাবুদ্দীন, চৌগাছা) ও শেখ মোর্তজা আলি দুলাল সুবিধামতো স্থান থেকে এলএমজি নিয়ে অনবরত গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। হঠাৎ শত্রুপক্ষের একটি গুলি মন্টুর পেটে লাগে এবং তিনি এলএমজি-সহ গড়াতে-গড়াতে একটি নালার কাছে এসে অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁকে উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে দ্রুত ভারতে পাঠানো হয় এবং তিনি দীর্ঘদিনের উন্নত চিকিৎসায় সুস্থ হন। সেদিনের দু-ঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা সুশীল সরকার (পিতা হাজুপদ সরকার, বাতুয়াডাঙা), মো. আবু বকর সরদার (কউরিয়া, কলারোয়া) ও মো. আব্দুল আজিজ (বারাত) শহীদ এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপরপক্ষে একজন পাকসেনা নিহত হয়।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার কিছু সময় পর ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ সফিকউল্লাহসহ বেশ কয়েকজন সংগঠক সেখানে উপস্থিত হন। তাঁরা সুভাষ সরকারসহ অন্যদের সহায়তায় তিনজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ মাগুরা গ্রামে এনে ক্ষত্রিয়পাড়ার একটি বাঁশতলায় সমাহিত করেন। এখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে।
মাগুরা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে হামলা করার জন্য যেসব রাজাকার পাকসেনাদের সহযোগিতা করেছিল, তাদের একজনের নাম মো. নুরুল ইসলাম (পিতা আব্দুল আজিজ শেখ, ইসলামকাটি/সুজনশাহ, তালা)। সে এখনো জীবিত। [শেখ সিদ্দিকুর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড