You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্থানীয় মুক্তিবাহিনী মহিউল আলম বাহিনী (পটিয়া, চট্টগ্রাম)

মহিউল আলম বাহিনী (পটিয়া, চট্টগ্রাম) ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলমের নেতৃত্বে গঠিত একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এ বাহিনী গঠিত হয়। বরিশালের অধিবাসী ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলম মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চন্দনাইশ উপজেলার বরমা ইউনিয়নে শাজাহান ইসলামাবাদীর দেউরি ঘরে ঘাঁটি স্থাপন করেন। তাঁর আহ্বানে চন্দনাইশ, পটিয়া, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য এবং এসব এলাকায় পালিয়ে আসা বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর সদস্যরা এ ঘাঁটিতে এসে যোগদান করেন। তাঁরা এখান থেকে মহিউল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেন। তাঁদের সংগঠিত করেন শাহ্জাহান ইসলামাবাদী (পিতা মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী), তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মুরিদুল আলম, ফরিদুল আলম প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আগ্রহী এলাকার সাধারণ লোকদেরও সংগঠিত করা হয়। তাদের সংগঠিত করতে প্রথম এগিয়ে আসেন শাহ্জাহান ইসলামাবাদী। পাকিস্তান আমলে তিনি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সে চাকরি করতেন এবং বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। চট্টগ্রামের মাদারবাড়িতে মগ ফইরো (পুকুর) পাড়ে তাঁর বাসা ছিল। তাঁর গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী এম এম নওশাদ আলী নামক এক ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার ৮ মাস আগে থেকে উক্ত বাসায় থাকতেন। ২৫শে মার্চের কয়েকদিন আগে তিনি ইসলামাবাদীর বাসা ত্যাগ করে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বরমায় নিজ বাড়িতে চলে আসেন। অতঃপর শাহ্জাহান ইসলামাবাদী ফ্লাইট সার্জেন্ট মহিউল আলমের সঙ্গে পরামর্শ করে বরমা ইউনিয়নের পল্লী চিকিৎসক গোলাম মাওলা (পিতা আবদুল গণি)-কে এম এম নওশাদ আলীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে আগ্রহীদের সংগঠিত করার নির্দেশ দেন। পরে শাহ্জাহান ইসলামাবাদী নিজেও উক্ত কাজে জড়িত হন। এ-সময় তাঁদের কাছে অস্ত্রের মধ্যে ছিল ২টি এসএলআর, ৩টি গ্রেনেড ও কিছু গুলি। এরপর একাজে জড়িত হন আওয়ামী লীগ নেতা মুরিদুল আলম ও ফরিদুল আলম। তাঁরা প্রথমদিকে যাদের সংগঠিত করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নুর মোহাম্মদ (পিতা মো. ছিদ্দিক, বরমা, চন্দনাইশ), এস এম আলমগীর আলম (পিতা বদিউল আলম, বাইনজুরি, বরমা, চন্দনাইশ), ইলিয়াছ চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান (পিতা মোহাম্মদ লাল মিয়া, বাইনজুরি, বরমা, চন্দনাইশ), মোজাহেরুল ইসলাম (পিতা মোহাম্মদ বকস, বাইনজুরি, বরমা, চন্দনাইশ), মোজহারুল হক চৌধুরী (পিতা আশরাফ আলী চৌধুরী, পূর্ব চন্দনাইশ), আবুল কালাম (পিতা ওবায়দুর রহমান, বরকল, চন্দনাইশ), মো. সোলায়মান (পিতা মোখলেছুর রহমান, বরকল, চন্দনাইশ), নুরুল হুদা (পিতা মোহাম্মদ কবির আহমদ, বরমা, চন্দনাইশ), রুস্তম আলী (সন্দ্বীপ), মো. সোলায়মান (পিতা মোখলেছুর রহমান, বরকল, চন্দনাইশ), হারুন (বরিশাল), মোহাম্মদ আহমদুর রহমান (পিতা আবদুর রহিম, বরকল, চন্দনাইশ) এবং জাহাঙ্গীর আলম (পিতা বদিউল আলম, বরমা, চন্দনাইশ)। এরাসহ মোট ২০ জন সাধারণ লোককে বরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ট্রেনিং প্রদান করা হয়। গোলাম মাওলা পল্লী চিকিৎসক হলেও তাঁর আনসার বাহিনীর ট্রেনিং ছিল। তিনি মহিউল আলমের নির্দেশে ২০ দিন ট্রেনিং প্রদান করেন। এ-সময় মহিউল আলমের ঘাঁটিতে অপারেশন কমান্ডার নিযুক্ত হন হাবিলদার আবু মো. ইসলাম। এক পর্যায়ে এ ঘাঁটিতে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠিত হলে মহিউল আলমকে প্রধান করে হাবিলদার আবু মো. ইসলাম গ্রুপ, মীর আহমদ চৌধুরী গ্রুপ, আবদুস সবুর খান গ্রুপ ও এম এ মজিদ গ্রুপ গঠন হয়।
মহিউল আলম এক পর্যায়ে ভারতে গমন করলে তাঁকে ৩৬টি গ্রুপের প্রধান এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে নৌ-কমান্ডো অপারেশন পরিচালনার জন্য আনোয়ারা থানার পশ্চিমাঞ্চলের সাগর উপকূলকে শত্রুমুক্ত করার গুরু দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। ৩রা আগস্ট ৩৬টি গ্রুপ নিয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হাফেজ মৌলভী আহমদুল হক (নাইখাইন, পটিয়া), নুর মোহাম্মদ ও জহুরুল হক। চট্টগ্রামের মিরসরাই, ফটিকছড়ি, আনোয়ারা, বোয়ালখালী ও পটিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে তিনি তাঁর অধীনস্থ গ্রুপসমূহ নিয়োগ করেন। পটিয়ার একটি গ্রুপ হলো এফএফ ৩৩। আনোয়ারা উপজেলায় আসার পর তাঁর সঙ্গে আরো কয়েকটি গ্রুপ যোগ দেয়। এখানে এফএফ ৩৬বি নামে ও একটি গ্রুপ তিনি সৃষ্টি করেন। সেপ্টেম্বর থেকে তিনি আনোয়ারার বারখাইনের আবদুল লতিফ, তফজল আহমদ ও আবদুল মাবুদ চৌধুরীর ঘরকে ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। সেপ্টেম্বরের পরে চন্দনাইশের বরকলে (কানাইমাদারি) তাঁকে প্রধান করে ৯৩ জনের আরো একটি গ্রুপ গঠিত হয়। এর কমান্ডার ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য নুরুল ইসলাম। এভাবে পুরো চট্টগ্রামে মহিউল আলমের বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে।
মহিউল আলম বাহিনী এবং এ বাহিনীর গ্রুপগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করে। এ-ক্ষেত্রে আনোয়ারা থানা অপারেশন, পশ্চিম আনোয়ারায় ৫টি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ২৩শে সেপ্টেম্বর মহিউল আলমের নেতৃত্বে পরিচালিত আনোয়ারা থানা অপারেশনে ১৫ জন রাজাকার ও মিলিশিয়া নিহত হয় এবং ৪ জন মিলিশিয়া ও ৫৮ জন পুলিশ- রাজাকার বন্দি হয়। এছাড়া ৩ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা ও রাজাকারদের বেতন উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৬টি স্টেনগান ও ৬৬টি রাইফেল। ৯ই নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মহিউল আলমের নেতৃত্বে পশ্চিম আনোয়ারায় ৫টি রাজাকার ক্যাম্পে অপারেশন পরিচালনা করে অর্ধশতাধিক রাজাকারকে হত্যা করেন। ১৮ই নভেম্বর বাঁশখালী উপজেলায় একটি রাজাকার ক্যাম্প অপারেশনে মহিউল আলম শহীদ হন। [শামসুল আরেফীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!