মহিষপুরা গণহত্যা (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট)
মহিষপুরা গণহত্যা (মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট) সংঘটিত হয় ১২ই মে। এতে অর্ধশতাধিক সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
হোগলাপাশা ও বনগ্রাম ইউনিয়ন শান্তি কমিটির নেতা ও অন্যান্য দালালদের আহ্বানে পিরোজপুরে অবস্থানরত পাকবাহিনী ১২ই মে বুধবার দুপুর বেলা বলেশ্বর নদী পাড়ি দিয়ে মহিষপুরা খেয়াঘাটে এসে পৌঁছে। এখানে এসে তারা স্থানীয় শান্তি কমিটির নেতা ও দালালদের সহায়তায় মহিষপুরা, ছোট হরিপুর, বড় হরিপুর, বৌলপুর, দাসখালী, বনগ্রাম, বলভদ্রপুর গ্রামে ব্যাপক লুটতরাজ, নারীনির্যাতন ও গণহত্যা চালায়। গ্রামগুলো পিরোজপুর-বাগেরহাট রাস্তার দুপাশে অবস্থিত এবং এর অধিকাংশ বাসিন্দা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের লুটপাটের ফলে গ্রামবাসীরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। কারো ঘরে এক বেলার খাবার পর্যন্ত ছিল না। লুটপাট শেষে হানাদাররা গ্রামগুলোতে পালাক্রমে আগুন লাগায়। এতে হাজারের অধিক ঘরবাড়ি পুড়ে ভস্মীভূত হয়। তারা গ্রামের অসংখ্য নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় এবং ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে গণহত্যায় মেতে ওঠে। পাকসেনারা অর্ধশতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। নিহতদের মধ্যে অনেকে অন্য এলাকার লোক ছিল। এসব শহীদের মধ্যে ১৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। ধর্ষিতা মহিলাদের অনেকে লোকলজ্জার ভয় ও যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেন। কেউ-কেউ ভারতে গিয়ে শরণার্থী হয়ে আর ফিরে আসেনি। সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে মহিষপুরা চিত্তরঞ্জন হালদারের বাড়িতে। চিত্তরঞ্জনের নব বিবাহিতা স্ত্রীকে তার সামনেই পাকপশুরা পাশবিক নির্যাতন করে। চিত্তরঞ্জন এর প্রতিবাদ করলে সঙ্গে-সঙ্গে তাকে গুলি করে হত্যা করে। বলভদ্রপুর গ্রামের সরকারি পুকুর পাড়ে ৮-১০ জন লোককে ধরে এনে পাকহানাদার বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। বনগ্রাম ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম কমিটির সভাপতি মুরারী পদের শশুর বাড়ির ৪-৫ জন লোককে হানাদাররা ধরে নিয়ে ঘরের সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেয়। হতভাগ্যরা আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়। ঘরের পাশে বাঁধা অবস্থায় ছিল মুরারী বাবুর ভাই। আগুনের তাপে তার শরীর ঝলসে যায়। আগুনে পুড়ে মৃত্যু ও গুলিতে হত্যার তাণ্ডব দেখে তার বাকশক্তি চিরদিনের জন্য লোপ পায়। ৪০ বছর যাবৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে পঙ্গুত্ব বরণ এবং অসহায় জীবনযাপন শেষে তার মৃত্যু হয়। মহিষপুরা গণহত্যায় নিহত শহীদরা হলেন- অতুল কৃষ্ণ সাহা (ছোট হরিপুর), গোপাল দত্ত (মোহনপুর), চিন্তাহরণ সাহা (পিতা বসন্ত সাহা, ছোট হরিপুর), নির্মল সাহা (পিতা হরিপদ সাহা, ছোট হরিপুর), ফণীভূষণ সাহা (পিতা অভিলাষ সাহা, ছোট হরিপুর), মণীন্দ্রনাথ সাহা (পিতা বিপিন সাহা), লক্ষ্মী কান্ত সাহা (পিতা ভদ্ৰকান্ত সাহা), শ্যামা চরণ সাহা (পিতা দ্বারিকা নাথ সাহা), ধীরেন্দ্র নাথ হালদার (পিতা গঙ্গাচরণ হালদার, দাসখালী), কালীপদ সমাদ্দার (বড় হরিপুর), মনি কান্ত দে (বৌলপুর), হৃষিকেশ দে (বৌলপুর), উপেন্দ্র নাথ হালদার (পিতা ভোলানাথ হালদার, মহিষপুরা), কুমুদ হালদার (পিতা বিনোদ হালদার, মহিষপুরা), চিত্তরঞ্জন হালদার (পিতা নকুল হালদার, মহিষপুরা), সতীশ হালদার (মহিষপুরা) ও বিনোদ বিহারী বাছাড় (বড় হরিপুর)। [শেখ মশিউর রহমান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড