মহিষাহাটি-মুরাদগড় যুদ্ধ (কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ)
মহিষাহাটি-মুরাদগড় যুদ্ধ (কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ) সংঘটিত হয় ৩রা এপ্রিল। এতে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও কয়েকজন গ্রামবাসী শহীদ হন।
মহিষাহাটি-মুরাদগড় যুদ্ধের স্থানটি কালীগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৬ কিমি দক্ষিণে এবং যশোর সদর থেকে ১৪ কিমি দূরত্বে সীমানারেখা বরাবর অবস্থিত। ১লা এপ্রিল বিষয়খালীতে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পাকসেনারা পিছু হটে যশোর সেনানিবাসে চলে যায়। এ স্থানটি কালীগঞ্জ থানার দক্ষিণের শেষ সীমানা হওয়ায় ইপিআর, আনসার, মুজাহিদসহ বাঙালি সেনারা পূর্ব থেকেই এখানে প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। ৩রা এপ্রিল পাকসেনারা সাতমাইল (বারীনগর) বাজারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে কালীগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার ফিরোজ খান (বরিশাল)-এর নেতৃত্বে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং স্থানীয় যোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল পাকা সড়ক দিয়ে সোজা বারোবাজারের দিকে এবং আরেকটি দল মহিষাহাটি গ্রামের উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা ঘটনাস্থলের নিকটে আসা মাত্রই সুবেদার ফিরোজ খানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা গ্রামের দক্ষিণের মাঠে ও মুরাদগড় (মান্দারতলা) পাকা সড়কের ওপর অবস্থান নেয়। আর মুক্তিযোদ্ধারা মুরাদগড় (মান্দারতলা) পাকা সড়কের পূর্বে অবস্থান নেন। উভয় পক্ষে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায়। ফলে তাঁরা পিছু হটে মহিষাহাটি গ্রামের ভেতর ঢুকে গ্রামের পূর্ব দিকের ব্রিজ পার হয়ে মাজদিয়া বাওড়ের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নেন। এ-যুদ্ধে ফজলুল হক (কুষ্টিয়া জেলা) নামে এক ইপিআর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে হত্যা করে। মহিষাহাটি গ্রামের লোকজন মিলে তাঁকে বাংকারের ভেতর কবরস্থ করে। তাঁর কবরস্থানটি ঐ গ্রামেই রয়েছে।
যুদ্ধের পরের দিন মহিষাহাটি গ্রামের দেলবার মৃধার (পিতা অছেল মৃধা) ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় মহিষাহাটি গ্রামের পশ্চিমে ঋষিপাড়ায়। ফজলুর রহমান (পিতা মুজিবর রহমান মণ্ডল) নামে অপর একজনের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল যুদ্ধস্থলের তিন কিমি উত্তরের বারোবাজার হাইস্কুলে অবস্থান নেয়। তাদের অপর একটি দল মহিষাহাটি গ্রামে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালিয়ে গ্রামের পূর্ব দিকের ব্রিজ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এরপর তারা বারোবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মহিষাহাটি গ্রামের নিয়ামত আলী মৃধার বৈঠকখানায় শেল নিক্ষেপ করে এবং বাড়িসহ সাতটি ধানের গোলায় অগ্নিসংযোগ করে। পূর্ব থেকেই মৃধাবাড়ির বৈঠকখানায় ইপিআর, আনসার ও মুজাহিদরা থাকতেন।
পাকিস্তানি সেনারা মহিষাহাটি গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু গ্রামের পূর্ব পাশে ব্রিজের উত্তরে মাজদিয়া বাওড় ও দক্ষিণে বিল থাকায় তারা পূর্ব দিকে আর অগ্রসর হয়নি। তাদের এ দলটি বারোবাজার হাইস্কুলে গিয়ে অপর একটি দলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে বারোবাজারে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। তারা পশ্চিমে সাকোমথনপুর ও পূর্বে সোনালীডাঙ্গা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের গুলিবর্ষণে বাদেডিহি গ্রামের বদরউদ্দীন মণ্ডল (পিতা মিয়াজান মণ্ডল) ও খোরশেদ মণ্ডলসহ (পিতা তাজেম মণ্ডল)-সহ অজ্ঞাত আরো অনেকে মারা যায়। হানাদাররা যশোর সেনানিবাসে ফিরে যাওয়ার পথে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে পুনরায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। মহিষাহাটি-মুরাদগড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন থানা কমান্ডার উলাদ হোসেন (মান্দারবাড়িয়া), সহকারী থানা কমান্ডার হেলাল উদ্দিন (হেলাই), আনসার কমান্ডার আবুল হোসেন (বেজপাড়া), স্থানীয় সাব-কমান্ডার আবুল কাশেম নালা (বাদুরগাছা) ও গ্রামবাসী। [মো. জুলফিকার আলী ভূট্টো]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড