You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৪৯-১৯৭১) বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের দুদিন পূর্বে চাঁপাইনবাবগঞ্জে শত্রুঘাঁটি দখলমুক্ত করতে গিয়ে শহীদ হন। ১৯৪৯ সালের ৮ই মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার ও মাতা সাফিয়া খাতুন।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। তিনি ১৯৬৪ সালে মুলাদি মাহমুদজান পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করে বরিশাল বি এম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে সেখান থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে বিএসসি (অনার্স) ক্লাসে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের উদ্দেশ্যে নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং তাতে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৭ সালে কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কমিশন লাভ করেন। কোর্স সম্পন্ন করে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়নে যোগ দেন। একই বছর তিনি লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। ১৯৭০ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে পদোন্নতি লাভ করেন। একজন দক্ষ অফিসার হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। সেখানে থাকাকালে বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারেন কীভাবে ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাখির মতো বাঙালিদের হত্যা করে। পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের বীভৎস হত্যাকাণ্ড একজন সৈনিক হিসেবে তাঁকে খুবই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করে। বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ঐ রাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা সারাদেশ জুড়ে পরবর্তীতেও তা চালিয়ে যাচ্ছিল। নিরীহ মানুষজনও রক্ষা পায়নি। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর পাকিস্তান থেকে দেশে ফিরে এসে হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন। ৩রা জুলাই জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে অপর তিন সহকর্মীসহ ছদ্মবেশে পাকিস্তানি রেঞ্জারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পায়ে হেঁটে ও ট্যাক্সিযোগে পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে ২০-২৫ মাইল দূরবর্তী মোনাওয়ার নদী সাঁতরে সীমান্তবর্তী ভারতের বিএসএফ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্সে পৌঁছেন। সেখান থেকে দিল্লি-কলকাতা হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে ৭নং সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নূর- উজ্জামানের অধীন মেহেদিপুর সাব-সেক্টরের কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি যুদ্ধে অসাধারণ নৈপুণ্য ও সাহসিকতার পরিচয় দেন; লিপ্ত হন শত্রুর বিরুদ্ধে একের পর এক সম্মুখ সমরে; মুক্ত করে চলেন একের পর এক শত্রুঘাঁটি। ডিসেম্বরের শুরুতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সর্বাত্মক অভিযান শুরু হয়। মেহেদিপুরের অদূরেই মহানন্দা নদী। নদীর অপর পারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর। পাকবাহিনী পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসে জড়ো হয়। পূর্বেই তারা নদীর তীর ঘেঁষে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এবং শহরের বিভিন্ন স্থানে সুউচ্চ দুর্ভেদ্য বাঙ্কার তৈরি করে ডিফেন্স নেয়। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৩ই ডিসেম্বর ৫০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল নিয়ে নৌকাযোগে মহানন্দা নদী পার হয়ে নিজেদের অবস্থান নিয়ে একের পর এক শত্রু ঘাঁটি দখলে নিতে থাকেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের মূল যুদ্ধ হয় ১৪ই ডিসেম্বর। পাকিস্তানি বাহিনীর অনবরত গুলিবর্ষণ সত্ত্বেও এক সময় তিনি অদম্য সাহসে একাই এগিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর বাঁ হাতে এসএমজি, ডান হাতে গ্রেনেড। শহরের নিকটবর্তী একটি বাড়ির ছাদ থেকে সক্রিয় শত্রুর মেশিনগান ধ্বংস করতে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তা পার হয়ে নিকট থেকে তিনি গ্রেনেড চার্জ করেন। এর ফলে মেশিনগানের স্থলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ঠিক সে সময়ে অপর একটি বাড়ির ওপর থেকে নিক্ষিপ্ত শত্রুর বুলেট এসে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের কপালে বিদ্ধ হয় ৷ সঙ্গে-সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন অসীম সাহসী এই বীর যোদ্ধা। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে শত্রুসেনারা রাতের আধারে শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। শহীদ মহিউদ্দিনের মৃতদেহ মুক্তিযোদ্ধারা উদ্ধার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সীমান্তের অদূরে সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে বীরের মর্যাদায় সমাহিত করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ ও অসামান্য বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাধি ও সমাধি কমপ্লেক্স, শহীদ হওয়ার স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ, তাঁর সমাধি সংলগ্ন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজ, স্মৃতি যাদুঘর, ঢাকার সেনানিবাসের প্রবেশ মুখে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর গেইট, নিজ গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর হাইস্কুল ও একটি কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!