মহম্মদপুর যুদ্ধ (মহম্মদপুর, মাগুরা)
মহম্মদপুর যুদ্ধ (মহম্মদপুর, মাগুরা) ১৯শে নভেম্বর সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে রাজাকারসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্য নিহত হয়। যুদ্ধে দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধা আহম্মদ হোসেন ও মোহাম্মদ হোসেন এবং রফিউদ্দিন ও ইপিআর সদস্য আহম্মেদ আলী পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।
মহম্মদপুর সদরে (উপজেলা পরিষদ) হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা টিটিডিসি ভবনে ক্যাম্প স্থাপন করে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে লুটপাট ও নিরীহ মানুষদের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প দখলের লক্ষ্যে আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮ই নভেম্বর রাতের প্রথমদিকে ক্যাম্প ইন-চার্জ মেজর হায়াত বেগ সকল সৈন্য ও রাজাকারদের একত্রিত করে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেয়। সে বলে (বঙ্গানুবাদ), ‘আমাদের চিরশত্রু হিন্দুস্থানের মদদে হাজার হাজার মুক্তি দেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ওদের সাথে সিভিল ড্রেসে ইন্ডিয়ান আর্মির সৈন্যরাও আছে। ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ হতে পারে। ভয়ের কিছু নেই। আমরা হলাম পৃথিবীর সেরা সৈন্যবাহিনীর সদস্য। দশদিন যুদ্ধ চালানোর মতো রসদ জমা আছে। দরকার হলে আমরা এয়ার সাপোর্ট পাবো। ওকে, গুড নাইট।’ অপরদিকে একই রাতে উপজেলা সদর থেকে ৪ মাইল দক্ষিণে ঝামা বাজারে পার্শ্ববর্তী মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগণ ও নড়াইল অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কমল সিদ্দিকীসহ সকলেই মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। ইয়াকুব বাহিনী ক্যাম্পের দক্ষিণ ও পশ্চিমে, কাজী নূর মোস্তফা ও আবুল খায়েরের বাহিনী উত্তরে, উত্তর-পূর্ব কোণে আহম্মদ-মোহাম্মদের দল। ২ ইঞ্চি মর্টারসহ কমল সিদ্দিকীর দল দক্ষিণ-পূর্বকোণে অবস্থান নেয়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের চারদিক ঘিরে ফেলেন। ভোররাতে তারা হানাদারদের ক্যাম্পে চতুর্মুখী আক্রমণ চালান। উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে গুলি বিনিময় হয়। এ-যুদ্ধে আহম্মদ হোসেন ও মুহাম্মদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কমল সিদ্দিকী, বীর উত্তম, গোলাম ইয়াকুব, বীর প্রতীক, কাজী নূর মোস্তফা, মো. রুস্তম আলী সিকদার, আব্দুর রশীদ বিশ্বাস, এডভোকেট আবুল খায়ের, মো. আব্দুল হাই মণ্ডল প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ক্যাম্পের মধ্যে কয়েকজন রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ছাদের বাংকারে বসানো মেশিনগান দিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। গোলাম ইয়াকুব বাহিনী গুলি ছুড়তে-ছুড়তে ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছলেও ছাদের শক্তিশালী মেশিনগানের কারণে সামনে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কমল সিদ্দিকী মেশিনগানে আঘাত হানার জন্য মর্টার হামলা চালান। কিন্তু গোলা লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় মেশিনগান অক্ষত থাকে। এরূপ কঠিন অবস্থায় আহম্মদ হোসেন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ হোসেন ছোট ভাইকে রক্ষা করার জন্য ছুটে যান। তিনিও পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহোদর দুই ভাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শাহাদত বরণ করেন। এ যুদ্ধে রফিউদ্দিন ও ইপিআর সদস্য মুহাম্মদ আলী নামে আরো দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজাকারসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এ-যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গুলি বর্ষণের জন্য হেলিকপ্টার পর্যন্ত ব্যবহার করে। নহাটা, জয়রামপুর ও মহম্মদপুর এ ৩টি যুদ্ধের সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী – কোলকাতা, অল ইন্ডিয়া রেডিও, রেডিও পাকিস্তান ও বিবিসি- লন্ডন থেকে প্রচারিত হয়। [সৈয়দ হাদিউজ্জামান]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড