You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মহাদেবপুর উপজেলা (নওগাঁ)

মহাদেবপুর উপজেলা (নওগাঁ) নওগাঁ জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে আত্রাই নদীর তীরে অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর মহাদেবপুরে ছাত্রলীগ – ও আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে শুরু করে। ২৫শে মার্চ ঢাকায় নিরীহ মানুষের ওপর পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ২৬শে মার্চ থেকে মহাদেবপুরে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মহাদেবপুর উপজেলা ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ২৭শে মার্চ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। মহাদেবপুর থানার ওসি গোলাম মোস্তফা (বাড়ি বগুড়ায়) স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র চালনার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবার এ উপজেলার অনেক মুক্তিযোদ্ধা ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্চ মাসে পাকবাহিনী মহাদেবপুরে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা মহাদেবপুরে প্রবেশপথের বসনা ব্রিজ ভেঙ্গে দিলে পাকবাহিনী মহাদেবপুরে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। পরে বিকল্প পথে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকবাহিনী মহাদেবপুরে প্রবেশ করে। তারা সর্বমঙ্গলা উচ্চ বিদ্যালয় ও ডাকবাংলোয় ক্যাম্প স্থাপন করে।
স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আহমদ আলী জামাদার, ডা. নজরুল ইসলাম, আজিম মাস্টার, আব্দুল জলিল, আব্দুল কাদের, আকবর আলী, আজেম উদ্দীন, ছোলেমান আলী, মোজাম্মেল হক প্রমুখ পাকবাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করে। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে এরা পাকসেনাদের নানাভাবে সহযোগিতা করে।
১৮ই এপ্রিল পাকবাহিনী সিদ্দিকপুর গ্রামের মানু মণ্ডলের পুত্র মছির উদ্দীনকে হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ায় নাটশালা গ্রামের ডা. তমিজ উদ্দীন ও বকাপুর গ্রামের কয়েম উদ্দিন মণ্ডলকে ধরে পাকবাহিনী আখেড়ায় নিয়ে তাদের ওপর নির্মম শারীরিক নির্যাতন চালায়। হানাদার বাহিনী আখেড়া হিন্দুপল্লীতে অগ্নিসংযোগ করে অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।
পাকবাহিনী মহাদেবপুরের বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ ও গণহত্যা ঘটায়। ২৪শে এপ্রিল পাকবাহিনী চকদৌলত ও বাজিতপুর গ্রামে হানা দিয়ে ১১ জন গ্রামবাসীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। চকদৌলত গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে ৫ জন ছিলেন বাজিতপুর গ্রামের, বাকিরা চকদৌলত গ্রামের। হানাদার বাহিনী এ দুগ্রামে কেবল হত্যাকাণ্ড চালায়নি, হিন্দুপাড়ার ৫০টি বাড়িও পুড়িয়ে দেয়।
২৬শে এপ্রিল পাকবাহিনী কয়েকজন মহিলাকে ধরে মহিষবাথান নামক স্থানে এনে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। নির্যাতিত নারীদের দুজন এখনো বেঁচে আছেন। এছাড়া খাজুর সড়ক, গোফানগর, মাদিশহর, দোহালী, সুলতানপুর ইত্যাদি গ্রামেও হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা নিপীড়ন, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ ঘটায়।
সর্বমঙ্গলা উচ্চ বিদ্যালয় ও ডাকবাংলোতে পাকবাহিনী নির্যাতনকেন্দ্র স্থাপন করে। তারা বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে ধরে এনে এসব ক্যাম্পে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাত।
মহাদেবপুরে আত্রাই নদীর খেয়াঘাট, শহীদ মিনারের পার্শ্ববর্তী এলাকা ও দেবীপুর মোড়ে পাকবাহিনীর হাতে নিহতদের গণকবর ও মহিষবাথানের বামনদহে বধ্যভূমি রয়েছে। তবে যথাযথ উদ্যোগের অভাবে
এসব গণকবর বধ্যভূমির একটিও সংরক্ষিত নেই। এসব গণকবর ও বধ্যভূমিতে নানা স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
মহাদেবপুর উপজেলার কোথাও পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ না হলেও উপজেলার অনেক মুক্তিযোদ্ধা পার্শ্ববর্তী উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১৫ই ডিসেম্বর মহাদেবপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। এদিন সকাল থেকে সর্বমঙ্গলা উচ্চ বিদ্যালয় ও ডাকবাংলো ক্যাম্পের পাকবাহিনীর সদস্যরা মহাদেবপুর ত্যাগ করা শুরু করে। বিকেলের মধ্যে সমগ্র মহাদেবপুর পাকহানাদার মুক্ত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধারা উপজেলার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মহাদেবপুর উপজেলার ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাঁরা হলেন— আইয়ুব আলী (দক্ষিণওড়া), সাইফুর রহমান (গ্রাম খাজুর), হারুন অর রশিদ (জয়পুর ডাঙ্গাপাড়া), আশরাফুল ইসলাম (বাগাচাড়া), আমিনুল ইসলাম (গ্রাম হর্ষি) ও নুরুল ইসলাম (হেলালপুর)। আইয়ুব আলী ও সাইফুর রহমান ১৯শে সেপ্টেম্বর সাপাহারে এবং আশরাফুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম ও হারুন অর রশিদ ১৩ই ডিসেম্বর যথাক্রমে সাপাহার, মেঘালয় সীমান্ত ও জয়পুর ডাঙ্গাপাড়ায় শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামকে ১২ই ডিসেম্বর রাজাকাররা কালুশহর বাজারে ধরে নিয়ে নির্যাতন শেষে হত্যা করে।
মহাদেবপুর উপজেলার দুজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হন। তাঁরা হলেন খোদ্দকালনা গ্রামের মো. সোহরাব হোসেন ও ইটালী গ্রামের অতুল চন্দ্র মণ্ডল। মো. সোহরাব হোসেন ১২ই সেপ্টেম্বর সাপাহার উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে আহত হন। অতুল চন্দ্র মণ্ডলকে রাজাকাররা পীরগঞ্জহাটে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে আহত করে।
মহাদেবপুর মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মোড়ে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও প্রজন্ম ৭১-এর উদ্যোগে উপজেলার ৬ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নামাঙ্কিত স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। চকদৌলতে গণহত্যার শিকার গ্রামবাসীদের স্মরণে এ গ্রামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। এছাড়া শহীদ নুরুল ইসলামের নামে মাতাজী বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [আজাদুল ইসলাম আজাদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!