মহামনিপাড়া অপারেশন (রামগড়, খাগড়াছড়ি)
মহামনিপাড়া অপারেশন (রামগড়, খাগড়াছড়ি) পরিচালিত হয় ১৪ই আগস্ট ভোরে। কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে ৬০ জন মুক্তিসেনা এ অপারেশনে অংশ নেন। এতে ১ জন অফিসারসহ ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফেনীসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল ১নং সেক্টরের অধীনে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার তিনটি মহকুমার মধ্যে একটি ছিল রামগড়। রামগড় মহকুমা ছিল মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের অধীন অন্যতম বেইস সেন্টার।
৭১-এর মার্চের অসহযোগ আন্দোলন-এর উত্তাল দিনগুলোতে রামগড়ের মানুষ সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছিল। রামগড় আওয়ামী লীগ-এর উদ্যোগে ১৬ই মার্চ রামগড় বাজারের বনবীথি বোর্ডিংয়ে এক জরুরি সভায় কাজী রুহুল আমীনকে আহ্বায়ক ও সাংবাদিক সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরাকে যুগ্ম-আহবায়ক করে ঐ সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
ভারত সীমান্ত লাগোয়া রামগড় শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল শক্ত ঘাঁটি। সহজেই ভারত থেকে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে শত্রুশিবিরে আক্রমণ করতেন।
১লা মে পর্যন্ত রামগড় ছিল মুক্ত এলাকা। এরপর রামগড়ের পতন হলে ভারতের ত্রিপুরার হরিণা ক্যাম্প হয়ে হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা ৪০ জনের একটি গ্রুপ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার অম্পি নগরে যান। শত-শত মুক্তিযোদ্ধা ত্রিপুরার হরিণা, উদয়পুর, আগরতলা, অম্পি নগর, শীলছড়ি, দেমাগ্রী প্রভৃতি ট্রেনিং সেন্টার থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে রামগড় সীমান্ত হয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশনে অংশ নেন।
দুর্ধর্ষ গেরিলা নেতা হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে ৫ই মে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়, যা ছিল বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামে এরূপ প্রথম কোনো মুক্তিযোদ্ধা দল। পরবর্তী সময়ে এর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজারে। এ দলের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, সালেহ আহমেদ, মনসুর আহমেদ, কালাচান দেববর্মণ, সন্তোষ নাথ, নীলকমল ত্রিপুরা, মুলকুতুর রহমান, ধীমান বড়ুয়া, মং কিউ মারমা প্রমুখ।
পার্বত্য অঞ্চলে চলাচলের সুবিধার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা রামগড়ের গভীর অরণ্য নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলাপাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যছোলা ও গাড়িটানায় গোপন আশ্রয় কেন্দ্ৰ স্থাপন করেন। এ কাজে পাহাড়ি হেডম্যান, কার্বারীসহ এলাকার লোকজন সহযোগিতা করে। হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা কমান্ডার হিসেবে মুখ্য ভুমিকা পালন করেন।
ইতোমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী রামগড়ে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসে। মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম হরিণা ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন অপারেশনের নির্দেশ দিতে থাকেন। আগস্ট মাসের দিকের ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে মহামনিপাড়া আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল ১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা। এ অপারেশনে পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যসহ প্রায় ৬০ জনের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল অংশগ্রহণ করে। কমান্ডার হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে এ দলে অং কিউ মারমা, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রফিক, রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, এলএমজিম্যান খ্যাত প্রিয়জ্যোতি রোয়াজা, নীল মোহন ত্রিপুরা, ভুবন ত্রিপুরা, ফিলিপ ত্রিপুরা বিজয়, সমর কৃষ্ণ চক্রবর্তী, কালাচান দেববর্মন, বাবুল মজুমদার, রণজিৎ কিশোর দেববর্মণ, মনিন্দ্র কিশোর ত্রিপুরা, নীলা মোহন ত্রিপুরা, মীর শাহনেওয়াজ ত্রিপুরা, গণচন্দ্র ত্রিপুরা, ধীমান কান্তি বড়ুয়া, লোকনাথ ত্রিপুরা, আবদুর রহমান-১, আবদুর রহমান-২, আলী আশরাফ মাস্টার, শেখ আহমেদ, সন্তোষ কুমার নাথ, নিতাই চন্দ্ৰ নাথ, দুলাল চন্দ্র দে, মুলকুতুর রহমান, আবুল কালাম, ছালেহ আহমেদ, বিনোদ বিহারী দাশ, সুলতান আহমেদ, যতীন্দ্র কুমার দাশ, মাখন বড়ুয়া, মো. তোফাজ্জল হোসেন, মমং মগ, ঝন্টু কুমার ঘোষ, বিজয় ত্রিপুরা, রাখাল চন্দ্র পাল, বিজয় চন্দ্র দাশ, মনোরঞ্জন দাশ, অনিল চন্দ্র দাশ, সমীর শীল, বরুণ চন্দ্র পাল, আবদুল বারেক, নুরুন্নবী চৌধুরী, অমূল্য চরণ দাশ, মো. সফর মিয়া প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দলে একজন ইপিআর সুবেদারও ছিলেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ই আগস্ট ভারতে সাব্রুম থেকে মুক্তিযোদ্ধা দলটিকে জিপে করে কিছু পথ এগিয়ে দেয়া হয়। এরপর তাঁরা বাকি পথ পায়ে হেঁটে আসেন। ফেনি নদী পার হয়েই তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। মহামনিপাড়ায় মহামনি মন্দিরের পার্শ্বে বিশাল একটি আখক্ষেত ছিল। রাতের বেলা তাঁরা আখক্ষেতেই আশ্রয় নেন। আখক্ষেতের পরেই মহামনিপাড়ার পাকা রাস্তা। সারারাত তাঁরা আখক্ষেতেই অপেক্ষায় থাকেন, কিন্তু কোনো শত্রুবাহিনীর দেখা মেলেনি। ভোররাতের দিকে দেখা যায় মিলিশিয়া বাহিনীর কিছু সদস্য এগিয়ে আসছে। তারা একজন থেকে আরেকজন ৩০-৪০ ফুট দূরত্বে হাঁটছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাভারের মধ্যে না আসায় তাদের ওপর আক্রমণ না করে তাঁরা অপেক্ষা করতে থাকেন। এক সময় মিলিশিয়ারা চলে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেন রাতের বেলা আক্রমণ পরিচালনার।
ততক্ষণে ভোরের সূর্য উঠেছে। বিপদের আশঙ্কায় মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ফিরে যাওয়ার জন্য একমত হন। তাঁরা যেই মাত্র ফিরে যাবেন ঠিক করেছেন, ঠিক তখনি রামগড়ের বাগান বাজার থেকে একটি জিপ আসার শব্দ শুনতে পান। কিছুক্ষণের মধ্যে জিপটি চোখের সীমানায় চলে আসে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জিপ। সামনে একজন অফিসার। পেছনে ৪ জন সিপাহি। জিপটিকে এম্বুশ করে মুক্তিযোদ্ধা দলটি। জিপটি রেঞ্জের মধ্যে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা এলএমজি, এসএলআর ও রাইফেলের সাহায্যে ফায়ারিং শুরু করেন। আক্রমণ করার সঙ্গে-সঙ্গে জিপের চালক লাফিয়ে ধানক্ষেতে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা এমনভাবে ফায়ারিং করতে লাগলেন যে, পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ করার সুযোগই পেল না। চালক প্রাণে বেঁচে গেলেও অফিসারসহ বাকি ৫ জন পাকসেনাই নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক রফিক ফায়ারিং করতে-করতে এক পর্যায়ে উত্তেজনাবশত এলএমজি নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। এ অবস্থায় তিনি ফায়ারিং করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ১৫-২০ মিনিট গুলি চালান। এরপর দ্রুত সরে পড়েন। গুলির শব্দ শুনে পাকিস্তানি সৈন্যরা দুদিক থেকে ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে তাঁদের ক্যাম্পের দিকে ফিরে যান। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটি ছিল একটি সফল অপারেশন। [ইয়াছিন রানা সোহেল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড