মুক্তিযুদ্ধে মহালছড়ি উপজেলা (খাগড়াছড়ি)
মহালছড়ি উপজেলা (খাগড়াছড়ি) ১৯৭১ সালে খাগড়াছড়ি থানার একটি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৮২ সালে এটি উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। এর উত্তরে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা, দক্ষিণে নানিয়ারচর ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা, পশ্চিমে মাটিরাঙ্গা ও রামগড় উপজেলা। মহালছড়ি মুক্তিযুদ্ধের সময় ১নং সেক্টরের অধীন ছিল|
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বে এখানে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন মাইসছড়ির চিত্তরঞ্জন কারবারী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ড. নীরু কুমার চাকমা এবং খাগড়াছড়ি সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. সুধীন কুমার চাকমার পিতা), গামারী ঢালার হেডম্যান গোরাঙ্গ মোহন দেওয়ান, নুনছড়ির সব্যসাচী চাকমা প্রমুখ। চিত্তরঞ্জন কারবারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা, তাঁদের জন্য অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
এখানকার অনেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদেশ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের হারিমা, বাগাফা, পালাটানা, হাপানি, তান্দোয়া প্রভৃতি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নেন। এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মহালছড়ি উপজেলার স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিরা সম্মিলিতভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে ত্রিপুরা রাজ্যের ডেরাডং জেলার তান্দোয়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে চালাপ্রু চৌধুরী, উগ্যজাই মারমা, কংক্যা মারমা ও ম্যাকজ্ঞি মারমা বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
২৫শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাকবাহিনী মহালছড়িতে অনুপ্রবেশ করে এবং এখানকার থানা ঘাটে ক্যাম্প স্থাপন করে।
এ উপজেলার শীর্ষস্থানীয় রাজাকার ছিল জন্টু মিয়া। পাকবাহিনীর অন্যতম দোসর ছিল বিন্দু কুমার এবং তার দত্তক পুত্র জাকারিয়া খান (বিহারি)।
পাকবাহিনী মহালছড়িতে নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা বদং মারমা (কমান্ডার পাড়া), অংজপ্রু মারমা (সিঙ্গিনালা পাড়া) ও কালাচান চৌধুরী (সিন্দুছড়ি)-কে হত্যা করে। এছাড়াও অনেক আদিবাসী নারী পাকসেনাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন। পাকসেনারা মহালছড়ি সদর ও সিঙ্গিনালার অনেক ঘরবাড়ি লুটতরাজ করে ও পুড়িয়ে দেয়। ১৩ই মে তারা আওয়ামী লীগ কর্মী ও সংগ্রাম কমিটির সদস্য চিত্তরঞ্জন কারবারী, গোরাঙ্গ মোহন দেওয়ান এবং সব্যসাচী চাকমাকে বাড়ি থেকে পুরাতন মাইসছড়ি বাজারে ধরে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে। পরের দিন মহালছড়ি বাজারের উত্তর দিকে তেলোন তাঙ্যা নামক স্থানে তাদের গুলি করে হত্যা করে।
পাকহানাদার বাহিনী থানা ঘাটে (বর্তমান উপজেলা সদর) স্থাপিত ক্যাম্পকেই তাদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করে।
২৭শে এপ্রিল পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম- শহীদ হন। অপরদিকে শত্রুপক্ষের অনেকে হতাহত হয়। এটি মহালছড়ি যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ১৬ই ডিসেম্বর মহালছড়ি উপজেলা শত্রুমুক্ত হয়।
এ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন ক্যাপ্টেন কাদের (মহালছড়ি যুদ্ধে শহীদ) এবং রমণীরঞ্জন চাকমা (ইপিআর সৈনিক, রামগড় যুদ্ধে শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ক্যাপ্টেন কাদেরের স্মরণে মহালছড়ি কলেজের সামনে ২৪ মাইল এলাকায় সড়কের পাশে একটি মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। [উহলা প্রু চৌধুরী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড