বীর প্রতীক মমিনুল হক ভূঁইয়া
মমিনুল হক ভূঁইয়া, বীর প্রতীক (মৃত্যু ১৯৯৪) বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের নকশা প্রণয়নকারী। তিনি কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার কালা সাদাধিয়া
গ্রামের ভূঁইয়া বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সিরাজুল হক ভূঁইয়া। মমিনুল হক ভূঁইয়া ছাত্রজীবন থেকে স্বাধীনচেতা ও সাহসী ছিলেন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে চাকরির মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করার কারণে তিনি বাঙালিদের প্রতি অবাঙালি অফিসার ও শ্রমিকদের অন্যায় ও অপমানজনক আচরণ কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান। ফলে চাকরির শুরু থেকেই পাকিস্তানিদের প্রতি তাঁর মনে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
৭১ সালের মার্চে সারাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বে যখন অসহযোগ আন্দোলন- চলছিল, তখন মমিনুল হক ভূঁইয়া কুমিল্লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। কুমিল্লায় সে- সময় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন মিছিল ও সমাবেশে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ২৫শে মার্চ ঢাকায় এবং এরপর কুমিল্লা শহর ও কুমিল্লা সেনানিবাসে বাঙালিদের ওপর হানাদার পাকিস্তানি সেনারা হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকলে মমিনুল হক ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি কর্মক্ষেত্র ত্যাগ করে কুমিল্লা ও দাউদকান্দি এলাকার বিভিন্ন প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে গেলে তিনি আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে ভারতের আগরতলায় যান। সেখানে গিয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বাধীন ২ নম্বর সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত হন। প্রথমে তাঁকে সেক্টরের প্রশাসনিক কাজে যুক্ত করা হয়। পরে সরাসরি যুদ্ধ করার আগ্রহ দেখালে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ শেষে মমিনুল হক ভূঁইয়া বৃহত্তর কুমিল্লা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায় পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। এসব অপারেশনে তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী হিসেবে তাঁর কর্ম-অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে কাজে লাগান। সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকৌশলী মমিনুল হক ভূঁইয়াকে ঢাকা, টঙ্গি, ঘোড়াশাল ও নারায়ণগঞ্জের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের একটি মডেল তৈরি করে দিতে বললে তিনি তা করে দেন। এ মডেলের ওপর ভিত্তি করে খালেদ মোশাররফ তাঁর সেক্টরের আওতাধীন এলাকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণ পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ করেন। মমিনুল হক ভূঁইয়া ৩রা নভেম্বর পরিচালিত নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র ধ্বংস করার অপারেশনে অংশ নেন। এ অপারেশন তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার রুমে কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁরা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দেন। অপারেশন শেষে ফেরার পথে তাঁরা পাকসেনা ও রাজাকারদের আক্রমণের মধ্যে পড়েন। এ আক্রমণে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মমিনুল হক ভূঁইয়া ও অন্য মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করেন। মমিনুল হক ভূঁইয়া এ- যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শন এবং এ ক্ষেত্রে প্রকৌশল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ব্যাপক প্রয়োগের স্বীকৃতিস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর সরকার মমিনুল হক ভূঁইয়াকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে যোগদান করেন। দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে কাজ করার পর তিনি কুমিল্লায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে উন্নীত হন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর রোজনামচা লেখার অভ্যাস ছিল। ১৯৭১ সালে লেখা তাঁর ডায়রিটি ঢাকার শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে সংরক্ষিত আছে। ১৯৯৪ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত থাকাকালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে ঢাকার মিরপুরস্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তিনি ৬ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম সুফিয়া খাতুন। [জালাল আহমেদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড