You dont have javascript enabled! Please enable it!

ময়না প্রতিরোধযুদ্ধ (লালপুর, নাটোর)

ময়না প্রতিরোধযুদ্ধ (লালপুর, নাটোর) ২৬শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত নগরবাড়ি ও পাবনা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে যাওয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আনসার, ইপিআর, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র ও মুক্তিকামী সর্বস্তরের জনতার সঙ্গে পথে-পথে প্রতিরোধযুদ্ধ সংঘটিত হয়। ৩০ ও ৩১শে মার্চ ময়নার গণযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এটি ছিল ভয়াবহ গণপ্রতিরোধযুদ্ধ। রাত ও দিনভর যুদ্ধ চলে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে পরাস্ত হয়। হানাদার বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী মেজর আসলাম হোসেন খান (রাজা খান)সহ বেশ কয়েকজন সদস্য পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকালে প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়ে তাদের দ্বারা নিহত হয়। এ প্রতিরোধযুদ্ধে অনেক আনসার, ইপিআর, পুলিশ ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন।
২৬শে মার্চ সকাল ১০টায় নওগাঁর ইপিআর উইং কমান্ডার মেজর নজমুল হক টেলিফোনে আনসারের ডেপুটি ডাইরেক্টরকে জানান যে, একদল পাকিস্তানি সৈন্য নগরবাড়ি ঘাট থেকে রাজশাহীর দিকে এগিয়ে আসছে। এ সৈন্যরা নিরাপদে রাজশাহী পৌঁছতে পারলে ফলাফল হবে ভয়াবহ। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ঐদিনই সন্ধ্যায় আনসার সদস্যরা পাবনা অভিমুখে রওনা হন। শঙ্কর গোবিন্দ চৌধুরী এমপিএ, মহকুমা কর্মকর্তা কামাল হোসেন, মেজর আনোয়ারুল আজিম প্রমুখ বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মুলাডুলি নামক স্থানে প্রথম আনসাররা পাকিস্তানি সৈন্যদের মুখোমুখি হন। তাঁদের আকস্মিক আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনী আশা করেনি। তাই আনসারদের প্রতিরোধের সামনে টিকতে না পেরে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং অন্য পথে রাজশাহীর দিকে এগুতে থাকে। এ-সময় আনসার কমান্ডার মো. ইউসুফের নির্দেশে হানাদারদের প্রতিহত করার জন্য একটি সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেয়ার জন্য আনসার সদস্যরা দ্রুত বনপাড়ার দিকে অগ্রসর হন। রাত ১০টায় আনসার বাহিনী বনপাড়ায় পৌঁছে যায় এবং সঙ্গে-সঙ্গেই খবর পাওয়া যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনী গোপালপুর হয়ে রাজশাহীর দিকে এগুচ্ছে। অবিলম্বে আনসারদেরও গোপালপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
এদিকে পাকবাহিনীর ২৫ রেজিমেন্টের সদস্যরা পাবনা মিলিটারি ক্যাম্প থেকে ৩টি জিপ ও ৬টি ট্রাকের একটি বহর নিয়ে নাটোরের পথে রাজশাহীর উদ্দেশে রওনা হয়। ২৯শে মার্চ পাবনার দাশুড়িয়ায় এলে তারা প্রতিরোধকারীদের কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়ে উত্তর দিকে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় ঢুকে পড়ে এবং গোয়াল বাথান হয়ে মুলাডুলি সিএসডি গোডাউনের পূর্ব পাশ দিয়ে আবারো পাবনা-রাজশাহী সড়কে ওঠে। সেখানে তারা জনতা কর্তৃক অসংখ্য কাটা গাছ ও কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়। অতঃপর তারা নিরুপায় হয়ে পাকা সড়কের পশ্চিম দিকে পুনরায় কাঁচা রাস্তায় ঢুকে পড়ে এবং লালপুরের মাঝগ্রামে রেলগেটে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেললাইন পার হয়ে টিটিয়া ও সুন্দরবাড়ীয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কদিমচিলাম ইউনিয়নের চাঁদপুর বাজার থেকে ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে লালপুরগামী মনির উদ্দিন আকন্দ রোড হয়ে গোপালপুরের দিকে রওনা হয়। ঐ সময় রাস্তার উভয় পাশের স্বাধীনতাকামী হাজার-হাজার মানুষ নিজেদের জীবনের পরিণাম বিবেচনা না করে লাঠিসোঁটা, বল্লম, তীর-ধনুকসহ বিভিন্ন দেশীয় হাতিয়ার নিয়ে হানাদার বাহিনীর পেছনে ধাওয়া করে। কিন্তু আধুনিক আগ্নেয় অস্ত্রের তুলনায় দেশীয় হাতিয়ার কিছুই নয়। এদিকে ঐ বহর গোপালপুরের রেলগেটে পৌছার পূর্বেই জনতা তা জানতে পেরে রেললাইনের ওয়াগন দ্বারা ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ক্ষিপ্ত পাকসেনারা রেলগেট এলাকায় নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এক পর্যায়ে তারা আবার গোলাবর্ষণ করতে-করতে একই রাস্তায় (মনির উদ্দিন আকন্দ রোডে) ফেরত যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু জনতা ইতোমধ্যে বিজয়পুর ও বামনগ্রাম সীমান্তে অবস্থিত ঈছামতি খালের ওপর একটি ব্রিজের (সিঙ্গি ব্রিজ বলে পরিচিত) পশ্চিম পাড়ের রাস্তা কেটে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এখানেই সংঘটিত হয় নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার ওয়ালিয়া ইউনিয়নের ময়না গণযুদ্ধ। সমস্ত রাত এবং পরের দিন ৩১শে মার্চ এক নাগাড়ে যুদ্ধ চলে। এদিন পকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও সম্মুখ যুদ্ধ করতে গিয়ে অনেক ইপিআর, আনসার, পুলিশ ও জনতা শহীদ হন।
হানাদারদের ছোড়া গোলার আঘাত নিয়ে এখনো জীবিত আছেন নান্দরায়পুর গ্রামের অনিল চন্দ্র সরকার, ওয়ালিয়া গ্রামের জবান আলী ও রুস্তুম আলী, ভবানিপুরের আবু বক্কার, ময়না গ্রামের নজরুল ইসলাম নজু, পানঘাটা গ্রামের ডা. নাদের আলী ও খোরশেদ আলী, চাঁদপুর গ্রামের আয়ুব আলী, দুয়ারিয়া গ্রামের ভবেশ চন্দ্র বিশ্বাসসহ আরো অনেকে। ঐ স্থানে রাস্তা কেটে প্রতিরোধ গড়ে তোলা অবস্থায় বেশ কয়েকজনকে পাকহানাদাররা হাতেনাতে ধরে অর্ধমৃত অবস্থায় খলিশাডাঙ্গা নদীর দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু নদীতে নেমে আর কোনো রাস্তা না পেয়ে তারা নদীর ওপারে (উত্তর পাড়ে) ময়না গ্রামে সৈয়দ আলী মোল্লা ও নওয়াব আলী মোল্লার বাড়ি দখল করে অবস্থান নেয়। ঐ ধৃত কয়েকজনকে তাদের ঘাঁটির পাশে আম গাছের সঙ্গে বেঁধে দিনভর নির্যাতন চালায়। এদিকে রুখে আসা জনতা, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা ধৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার করার জন্য পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলেন এবং তাদের ঘায়েল করার জন্য কৌশল আঁটতে থাকেন। অপরপক্ষে, পাকিস্তানি সেনাদের উদ্ধার করার জন্য কয়েকটি হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণ করা হয় এবং হেলিকাপ্টার ল্যান্ড করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এছাড়াও, ঐ সময় বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান মহড়া দেয় ও গোলাবর্ষণ করে। ইতোমধ্যে শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচণ্ড গোলা বিনিময় এবং তা চলতে থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত ধৃত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে না পেরে গোটা এলাকা ঘিরে রাত্রি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকেন বাঙালি যোদ্ধারা। ওদিকে পাকসেনারা পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ধৃত ব্যক্তিদের গাছে ঝুলিয়ে চরম নির্যাতন শেষে গুলি করে হত্যা করে এবং নিজেরা রকেট শেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে ধৃত ব্যক্তিদের একজন মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ প্রামাণিক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় লাশের মাঝখান থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন এবং পাকসেনাদের গোলা-বারুদ শেষ ও নাজুক পরিস্থিতির খবর জানিয়ে দিলে রাত্রেই বীর জনতা আরো কঠোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে পুনরায় আক্রমন শুরু করে। তখন শেষ রাত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫ রেজিমেন্টের সেনারা প্রতিরোধকারীদের হাতে পরাস্ত হয়ে ছদ্মবেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু হানাদার বাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ বাহিনী প্রধান মেজর আসলাম হোসেন খান (রাজা খান) জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং তাদের সকলকে হত্যা করা হয়।
এদিন শত্রুর মোকাবেলা করতে গিয়ে প্রতিরোধকারীদের মধ্যে যারা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন- ময়না গ্রামের সৈয়দ আলী মোল্লা, মসলেম উদ্দিন মোল্লা (শিক্ষক), আবুল কাশেম মোল্লা, আয়েজুদ্দিন মোল্লা, খন্দকার নুরুননবী মন্টু, নান্দ গ্রামের কেয়ামত শেখ, ওয়ালিয়া গ্রামের খাইরুল আলম সাত্তার, বক্স সরদার, করম আলী, পানঘাটা গ্রামের আবেদ আলী, ধুপইল গ্রামের আবুল কালাম আজাদ, টিটিয়া মাঝ গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস, কালু মিয়া, বামন গ্রামের সেকেন্দার আলী, বিজয়পুরের আছের উদ্দিন, ভবানিপুরের জয়নাল আবেদীন, চেরু প্রামাণিক, দয়রামপুরের নুরুননবী, বাহাদিপুরের ইয়াছিন আলী, মধুবাড়ী গ্রামের যুধিষ্ঠির প্রামাণিক, নাটোর নিচা বাজারের মুংলা দাস, চাঁদপুর কদিমচিলানের সাহেব উল্লা, ডাঙ্গাপাড়া চিলানের আ. গফুর এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা নাম না জানা স্বাধীনতাকামী আরো অনেক জনতা, ইপিআর ও আনসার সদস্য। শহীদদের স্মরণে ময়নায় নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। এলাকাবাসী প্রতিবছর ৩০শে মার্চ সকাল থেকে দিনব্যাপী স্মৃতিসৌধ চত্বরে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা সভা ও অন্যান্য শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। [সুমা কর্মকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!