ময়নামতি সেনানিবাস গেইট গণকবর (কুমিল্লা আদর্শ সদর)
ময়নামতি সেনানিবাস গেইট গণকবর (কুমিল্লা আদর্শ সদর) কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকহানাদাররা এখানে ২৪ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করে গণকবর দেয়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর অপারেশন সার্চলাইট নামে গণহত্যা চালায়। এ গণহত্যা ছিল পূর্বপরিকল্পিত। তারই অংশ হিসেবে একদিকে যেমন তারা পাকিস্তান থেকে অস্ত্র ও সৈন্য নিয়ে আসছিল, অন্যদিকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত বাঙালি সৈন্যদের ছোট-ছোট গ্রুপে বিভক্ত করে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছিল। আবার অনেককে কৌশলে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। একইভাবে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড- ইন-কমান্ড মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম কে ২৪শে মার্চ সিলেটের শমসেরনগর এবং এর পূর্বে মেজর শাফায়াত জামিল, বীর উত্তম কে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। সর্বশেষে ৪র্থ বেঙ্গলের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন এইচ এম আব্দুল গাফফারকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। এসব বাঙালি অফিসার বিশেষ করে ক্যাপ্টেন আব্দুল গাফফার বিদায়কালে কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বিভিন্ন কোরের বাঙালি সেনা অফিসারদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের অনেকেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে না পেরে সেখানে থেকে যান। ফলে যা অনিবার্য, তা-ই ঘটে। অর্থাৎ ২৫ ও ২৬শে মার্চ বাঙালি অফিসার ও সেনাসদস্যদের গ্রেপ্তার করে রাতে একটি কক্ষের মধ্যে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা মেশিনগান চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। আহত অবস্থায় লে. ইমামুজ্জামান সেখান থেকে জানালা দিয়ে বের হয়ে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ধানক্ষেতে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে তেলিয়াপাড়াস্থ হেডকোয়ার্টার্সে নিয়ে যায়। সুস্থ হয়েই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পাকহানাদাররা বাঙালি সামরিক অফিসার-সদস্য ছাড়াও তাঁদের পরিবারের অনেক বেসামরিক সদস্যকেও হত্যা করে। এভাবে নির্মম-নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার ২৪ জন শহীদকে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের প্রবেশদ্বারের মূল ফটকের পাশে গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর গণকবর খুড়ে শহীদদের পরিধেয় সামরিক ও বেসামরিক পোশাক ও দেহাবশেষ পাওয়া যায় এবং অনেককে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়। এঁদের মধ্যে ১৬ জন সেনা অফিসার-সদস্য এবং বাকিরা বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ। যেসব সামরিক অফিসারদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে, তাঁরা হলেন- লে. কর্নেল আনোয়ারুল ইসলাম, লে. আজিজুর রহমান, লে. হারুন, মেজর হাসিব, ক্যাপ্টেন মকবুল আহমেদ, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন আরুব আলী, নায়েক সুবেদার আব্দুল হামিদ ও ল্যান্স নায়ক এস এইচ রহমান। বেসামরিক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এসব শহীদের স্মরণে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশের মূল ফটকে ‘যাদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ’ কথাটি লিপিবদ্ধ রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: এইচ এম আব্দুল গাফফার, বীর উত্তম, স্মৃতিময় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার সামরিক জীবন, প্রথমা ২০১৬, পৃ. ৫৩ এবং কুমিল্লা থেকে পাওয়া ছবি।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড