You dont have javascript enabled! Please enable it!

ময়নামতি সেনানিবাস গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর)

ময়নামতি সেনানিবাস গণহত্যা (কুমিল্লা আদর্শ সদর) ২৫শে মার্চ থেকে কুমিল্লা হানাদারমুক্ত হওয়া পর্যন্ত চলে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এ নিষ্ঠুরতম গণহত্যায় সহস্রাধিক মানুষ শহীদ হন।
৭১-এর ২২শে মার্চ থেকে ময়নামতি সেনানিবাসে পাকিস্তানের কমান্ডো ও গোলন্দাজ বাহিনী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারদিকে পরিখা খনন করে। তারা বাঙালি অফিসারদের কমান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়ে দেয়। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তারা সেনানিবাসে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।
ময়নামতি সেনানিবাসের পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকুব মালিক ২৫শে মার্চ রাতে অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করে বলে, ‘তোমরা এক্ষুণি শহরে বেরিয়ে পড়। ঘরের বাইরে যাকেই পাবে গুলি করবে। কাল সকালের মধ্যেই আমি সারা শহর লাশে ভর্তি দেখতে চাই। বেলা ১২টার মধ্যেই পরিস্থিতি যেন সম্পূর্ণ আয়ত্তে আসে।’ সভায় বাঙালি অফিসারদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন ইমাম- উজ-জামান, ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এ এল এ জামান এবং ক্যাপ্টেন সগীর আহমদ সিদ্দিকী। সভায় বলা হয়, বাঙালি হত্যা বাঙালি অফিসারদের জন্য অপ্রীতিকর হতে পারে। এজন্য তারা অপারেশনে না গিয়ে অফিসে দায়িত্ব পালন করবে। ২৬শে মার্চ সকালে ৫৩ বিগ্রেডের গোলন্দাজ ইউনিটের অধিনায়ক প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইয়াকুব মালিকের নির্দেশে সেনানিবাসে গণহত্যা চালানো হয়। তারা সেনানিবাসের বাঙালি অফিসার, সৈন্য ও কর্মচারীদের হত্যায় মেতে ওঠে।
হানাদার বাহিনীর এ গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ক্যাপ্টেন ইমাম- উজ-জামান, বিডি মেম্বার আবদুর রহমান (নিশ্চিন্তপুর), কোতয়ালি থানার সাব-ইন্সপেক্টর বজলুর রহমান ও রমণী মোহন শীল (ময়নামতি সেনানিবাসের বেসামরিক কর্মচারী)। ২৭শে মার্চ কুমিলার জেলা প্রশাসক শামসুল হক খান এবং পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে এনে সেনানিবাসের একটি কক্ষে আবদ্ধ করে রাখে। ৩০শে মার্চ সেনানিবাসের অন্যত্র গুলিবর্ষণের সঙ্গে এখানে গুলি করে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে হত্যা করা হয়। ইমাম-উজ-জামান এদিন আহত অবস্থায় ক্যান্টেনমেন্ট থেকে পালাতে সক্ষম হন।
এখানে আরো হত্যার শিকার হন কুমিল্লা পুলিশ লাইন্স থেকে ধরে আনা ইন্সপেক্টর প্রফুল কুমার দে, সাব-ইন্সপেক্টর অর্জুনচন্দ্র দে, রিজার্ভ ইন্সপেক্টর এ বি এম আবদুল হালিম ও তাঁর কলেজ পড়ুয়া দুই ছেলে, ফোর্স সুবেদার রুহুল আমিন এবং মুরাদনগর থানা থেকে ধরে আনা সার্কেল ইন্সপেক্টর খগেন্দ্রলাল চাকমা, এএসআই গঙ্গারাম চৌধুরীসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য।
মুক্তিযুদ্ধকালে ময়নামতি সেনানিবাসের পুরো এলাকা বধ্যভূমি ও গণকবরে পরিণত হয়েছিল। সেনানিবাসে যেসব বাঙালি অফিসার ও জওয়ান আটকা পড়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই নির্মম গণহত্যার শিকার হন। শহরের বেসামরিক লোকজনকেও এখানে ধরে এনে হত্যা করা হয়। বাঙালি অফিসার, সৈনিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক, সরকারি কর্মচারী, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহবধূ, এমনকি মসজিদের ইমাম পর্যন্ত এ গণহত্যা থেকে রেহাই পাননি।
২৯শে মার্চ বাঙালি অফিসার ও বেসামরিক কর্মচারীসহ ৩ শতাধিক মানুষ ব্রিগেড অফিসের পাশের একটি কুল গাছের নিচে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। সেনানিবাসের দক্ষিণে মাঠজুড়ে ছিল অসংখ্য গর্ত। প্রতিটি গর্তেই ছিল অসংখ্য কঙ্কাল। মাঠে ছড়িয়ে ছিল শতশত হাড় ও মাথার খুলি, হাত- পা বাঁধা অবস্থায় বিকৃত লাশ, কোথাও পড়েছিল মাথার চুল। মাঠের পূর্বদিকে বিরাট ৩টি ডোবায় বহু মানুষকে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়। সেনানিবাসে বেসামরিক মানুষের মধ্যে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ভাষা-সংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এম সি রায় চৌধুরী, অসীম শান্তি রায়, যতীন্দ্রনাথ ভদ্র ও তাঁর ছেলে কাজল ভদ্র ও রতন ভদ্র, অতীন্দ্রনাথ ভদ্র, সাহা মেডিকেলের নিতাই সাহা, বেনু গুহ, কে ডি রায়, শিশিরেন্দু দাশগুপ্ত প্রমুখ।
হানাদার বাহিনী বিগ্রেড হেডকোয়াটার্সের বিপরীত দিকে ২৪ নং এফএফ রেজিমেন্টের কোয়ার্টার গার্ড সেনানিবাসের বিভিন্ন ইউনিট হতে জমাকৃত কয়েকশত বাঙালিকে ফতেহ মোহাম্মদ স্টেডিয়ামের দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে গুলি করে। তারা বিগ্রেড হেডকোয়ার্টার্সের কাছাকাছি কর্নেল জাহাঙ্গীরসহ ২৪ জন কর্মকর্তা ও শতাধিক বাঙালিকে হত্যা করে একটি গর্তে মাটিচাপা দেয়। ২৭শে মার্চ তারা একটি বৃহদাকার ট্রাক ভর্তি মৃতদেহ কুমিল্লা শহর থেকে এনে ফতেহ মোহাম্মদ স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশে মাটিচাপা দেয়।
ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার ইস্পাহানী স্কুল ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। স্কুলের দোতলায় ময়নামতি সেনানিবাসের বাঙালি অফিসার ও কর্মচারীদের ৮০টি পরিবারকে আটকে রাখা হয়। স্কুলের নিচতলায় ছিল হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনকে শেষরাতে ধরে আনা হতো। সন্ধ্যায় গাড়িতে করে নিয়ে যেত। তাদের আর কোনো সন্ধান মিলত না। বিজয় অর্জনের পর এখান থেকে কয়েক শত লাঞ্ছিত নারীকে উদ্ধার করা হয়। দৈনিক পূর্বদেশ ৭ই জানুয়ারি ১৯৭২ সংখ্যায় এখান থেকে ৭ শত বিবস্ত্র মহিলাকে উদ্ধারের সংবাদ প্রকাশ করে।
মুক্তিযুদ্ধের পর ৭২-এর ২৭শে এপ্রিল আর্মি মেডিকেল কোরের কমান্ড্যান্ট শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ গণকবর থেকে উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারদের উপস্থিতিতে তোলা হয়। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী জানাজা পড়ে ২১ বার তোপধ্বনি করে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সঙ্গে কুমিল্লা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। ২২শে জুন অনুরূপভাবে উদ্ধার করে পূর্ণ মর্যাদায় দাফন করা হয় মেজর হাসিব, ক্যাপ্টেন আয়ুব আলী ও লেফটেন্যান্ট হারুনের মৃতদেহ। এখানে আরো শহীদ হন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আনোয়ার, মেজর খালেক, মেজর শহিদুজ্জামান, ক্যাপ্টেন হুদা, লেফটেন্যান্ট সালাউদ্দিন, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান, ক্যাপ্টেন নূরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন সিদ্দিক প্রমুখ।
ময়নামতি সেনানিবাস গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি, ইফতেখার হায়দার শাহ, কর্নেল খিজির হায়াৎ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল বাকী, মেজর সুলতান আহমদ, ক্যাপ্টেন বোখারী, ক্যাপ্টেন জাভেদ ইকবাল, লেফটেন্যান্ট মীর, মেজর সেলিম, মেজর মোস্তফা, মেজর সিদ্দিকী, ক্যাপ্টেন বকর প্রমুখ। তাদের সহযোগিতা করে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের অধ্যক্ষ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম কে আমীন এবং কুমিল্লা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাঙ্কের ব্যবস্থাপক আলীম।
ময়নামতি সেনানিবাসে রয়েছে অনেকগুলি গণকবর, বধ্যভূমি ও নির্যাতনকেন্দ্র। সেনানিবাসের এম আর চৌধুরী গ্রাউন্ডের পাশে রয়েছে গণকবর। সেখানে আনুমানিক ৩০০ সেনাসদস্য, ২৪ জন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও শতশত বাঙালিকে গুলি করে হত্যা করে গর্তে ফেলে দেয়া হয়। এখানকার একটি স্মৃতিফলকে ১০৩ জনের নাম রয়েছে। সেনানিবাসের ভেতরে ‘স্কোয়াশ’ নামে দুই কক্ষের একটি ভবনে বহু লোককে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ভবনের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল নিরীহ মানুষের লাশ। এছাড়া সেনানিবাসের ১১৮ ফিল্ড ওয়ার্কশপ এলাকায়ও রয়েছে গণকবর। সেখানে নামফলকে ৫৩ জন শহীদের নাম রয়েছে। একই এলাকায় রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যবহৃত এক দরজাবিশিষ্ট একটি টর্চার সেল। বিগ্রেড সদর দপ্তরের চারপাশে রয়েছে অনেকগুলো গণকবর। ময়মনসিংহ সেনানিবাসে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে। [মামুন সিদ্দিকী]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!