You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা

ময়মনসিংহ সদর উপজেলা ১৯৫২ সালের ভাষা- আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-এ ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পরও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ১লা মার্চ সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এতে ময়মনসিংহের সর্বস্তরের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২রা মার্চ ময়মনসিংহে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৩রা মার্চ বিকেলে ময়মনসিংহ টাউন হলের সামনে নাজিমউদ্দিন আহমেদ (ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ-এর সভাপতি)-এর নেতৃত্বে এক ছাত্র-গণসমাবেশে পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলন করেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া। সভা পরিচালনা করেন জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। তাঁর ডাকে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার মানুষের মধ্যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয় এবং তারা সর্বাত্মক অসহযোগ পালন করে। এভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পরের দিন ৮ই মার্চ প্রথমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম-কে সভাপতি করে ময়মনসিংহ জেলা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকায় তাঁর কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করতে হওয়ায় এরপর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া (সভাপতি, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ)। সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের মধ্যে সৈয়দ আব্দুস সুলতান এমএনএ, এ এন এম নজরুল ইসলাম এমএনএ, এম জাবেদ আলী এমএনএ, এ কে মোশাররফ হোসেন এমএনএ, হাতেম আলী তালুকদার এমএনএ, শামছুল হক এমপিএ, খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ এমপিএ, হাতেম আলী মিয়া এমপিএ, জেলা আওয়ামী লীগের আনিসুর রহমান খান, সৈয়দ আহমদ, অধ্যক্ষ মতিউর রহমান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। একই সঙ্গে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি ময়মনসিংহের বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম শিবির গঠিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক আলী নওয়াজ, অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন, অধ্যাপক শামছুজ্জামান খান, অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী, অধ্যাপক যতীন সরকার, অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম, ক্রীড়া সংগঠক পীযূষ কান্তি ঘোষ প্রমুখ। যুবনেতা আবুল হোসেনের উদ্যোগে গঠিত হয় জয়বাংলা বাহিনী।
৮ই মার্চ থেকে সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে ময়মনসিংহ জেলা স্কুল, আনন্দমোহন কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, নাসিরাবাদ গার্লস স্কুল, আখতারুজ্জামান কলেজ, মিন্টু কলেজ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। জেলা স্কুল মাঠে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেন আবুল হাশেম। আনন্দমোহন কলেজে প্রশিক্ষণের নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক কফিল উদ্দিন আতহার ও হামিদুল হক (ভিপি, আনন্দমোহন কলেজ ছাত্র সংসদ)। ২৬শে মার্চ ময়মনসিংহ সিটি স্কুলে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। কয়েকদিন পরে তা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার বাসায় স্থানান্তরিত হয়। ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া (সভাপতি, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ), সৈয়দ আব্দুস সুলতান এমএনএ, এ এন এম নজরুল ইসলাম এমএনএ, এম জাবেদ আলী এমএনএ, একে মোশাররফ হোসেন এমএনএ, হাতেম আলী তালুকদার এমএনএ, শামুছল হক এমপিএ, খোন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ এমপিএ, হাতেম আলী মিয়া এমপিএ, আনিসুর রহমান (কোষাধ্যক্ষ, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ), সৈয়দ আহমদ (দপ্তর সম্পাদক, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ), প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান, আতাব আলী (ন্যাপ),নাজিম উদ্দিন আহমেদ (সভাপতি, ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ), সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (সাধারণ সম্পাদক, ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগ) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এখানে যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মো. রিয়াজ উদ্দিন (পিতা এইচ ইউ মিয়া, বিদ্যাগঞ্জ), মতিউর রহমান বেগ (পিতা আমান উল্লাহ বেগ, দাপুনিয়া), আব্দুর রহিম (পিতা রিয়াজ উদ্দিন, কাঁচিঝুলি), আবুল হাসেম (পিতা জহির উদ্দিন, মহারাজা রোড) এবং আহাম্মদ হোসেন (অষ্টাধর)।
ময়মনসিংহের খাগডহরে ২৭শে মার্চ রাতে অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। স্থানীয় জনতাও এতে যোগ দেয়। ময়মনসিংহ খাগডহর প্রতিরোধ যুদ্ধে ১২১ জন পাকিস্তানি ইপিআর সদস্য নিহত হয় এবং সিওসহ ১৭ জন অফিসার আত্মসমর্পণ করে।
২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী ময়মনসিংহ সদর থানায় প্রবেশ করে এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ডাকবাংলো, খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প, খাগডহর ভেটেরিনারি অফিস ও টাউন হলে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরানগঞ্জ ও পিয়ারপুরে রাজাকাররা ক্যাম্প স্থাপন করে।
পাকহানাদার বাহিনীর উদ্যোগে মে মাসে ময়মনসিংহ সদর থানায় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। যাদের নেতৃত্বে এসব গঠিত হয় তাদের মধ্যে মওলানা ফয়জুর রহমান (শান্তি কমিটির আহ্বায়ক ও ময়মনসিংহ সদর জামে মসজিদের পেশ ইমাম), ফখরুদ্দিন আহমেদ (প্রাক্তন উজির), এম এ মান্নান (মুসলিম লীগ- নেতা ও প্রাদেশিক পরিষদের সাবেক সদস্য), দিদার (গোলকিবাড়ি, আলবদর প্রধান), আব্দুল হান্নান (নতুন বাজার, মুসলিম লীগ নেতা ও কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার), ভোলা মিয়া রাজাকার (ছোটবাজার), শওকত আলী মৌলভী, বিহারী নূর মোহাম্মদ (দুর্গাবাড়ি রোড), আব্দুল জব্বার (বিসকা), শামছুদ্দিন সুরুজ, রজন আলী, খোরশেদ তালুকদার (ময়মনসিংহ পৌরসভা), মেহেদী খান, মো. তাহের, খাদেম-ই-মোমেনেশাহী নজর আব্বাস (ময়মনসিংহ পৌরসভা, আলবদর) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
ময়মনসিংহ সদরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী সংগঠন শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা এবং অন্য দোসররা ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালায়। বিশেষকরে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনের পর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন, হত্যা ও ধর্মান্তরণের তৎপরতা বেড়ে যায়। ২৩শে এপ্রিল পাকবাহিনী ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করেই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী বৃদ্ধ মধুসূদনকে তাঁর কেওয়াটখালীর বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথে গুলি করে হত্যা করে। ২৬শে মে কর্মচারী হাসান আলীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দেয়। ১৭ই জুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন দিঘারকান্দা গ্রামের চুপিরবাড়িতে ঢুকে পাকবাহিনীর একটি গ্রুপ ১৫-১৬ জন যুবতীর ওপর নির্যাতন করে। গ্রামবাসী বাধা দিলে তিনজনকে তারা গুলি করে হত্যা করে। সেদিন পাকবাহিনীর নির্যাতনে দুজন গ্রামবাসী আহত হন। পাকবাহিনী ময়মনসিংহ সদরের ভাস্কর্য শিল্পী আব্দুর রশিদ সরকারকে হত্যা করে এবং রাজাকারদের সহযোগিতায় তাঁর নির্মিত ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘মা ও শিশু’, ‘যিশু’সহ অন্যান্য ভাস্কর্য ধ্বংস করে। মুক্তিযোদ্ধা আতা তাঁর নবজাতককে দেখতে গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন। রাজাকাররা তাঁকে মাইজবাড়ি গ্রাম থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন শেষে নির্মমভাবে হত্যা করে। রাজাকার আব্দুল হান্নান খুবই কুখ্যাত ছিল। সে ময়মনসিংহ শহরের অনেক বাসাবাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। হত্যার পাশাপাশি সে হানাদার ক্যাম্পে নারী সরবরাহ করত|
কুখ্যাত আলবদর প্রধান দিদারের গোলকিবাড়ি রোডের বাসাটি ছিল একটি নির্যাতনকেন্দ্র। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বাঙালিদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হতো। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হককে ময়মনসিংহ শহরের এক বাসা থেকে আলবদররা ডাকবাংলোয় ধরে এনে চরম নির্যাতন করে। ১৫ই নভেম্বর মুকুল নিকেতনের অধ্যক্ষ আমির আহমেদ চৌধুরীকে ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট হাউসে এনে তাঁর ওপর চরম নির্যাতন চালানো হয়।
ময়মনসিংহ সদরে রাজাকার আব্দুল জব্বারের কর্মকাণ্ড ও ছিল বর্বরোচিত। সে বহু বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। বিসকা রেলস্টেশনের নিকটস্থ আবার বিলের পাশে ছিল একটি রাজাকার ক্যাম্প। রাজাকার আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে পাকবাহিনী বিসকা, শালিহর ও বাঘুয়াদি গ্রামে বহু লোককে হত্যা করে। আব্দুল জব্বারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল কমর উদ্দিন, ডাকাত জয়নাল ও স্টেশন মাস্টার ছালিম। পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পাশাপাশি জোর করে ধর্মান্তরিত করার কাজেও লিপ্ত হয়। মওলানা ফয়জুর রহমান ও তার সহযোগীরা অধ্যাপক যতীন সরকারের স্ত্রী ও তাঁর শ্বশুরের পরিবারকে মানসিক চাপে ফেলে ধর্মান্তিরত করে। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত জেলা জজ দ্বিজেন চৌধুরী, শিল্পী সুনীল ধর, শশাঙ্ক মোহন দে (বেগুনবাড়ি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক), নৃপেন সরকার, মনোরঞ্জন সেন, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্যসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোককে তারা জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে।
৩রা ডিসেম্বর ময়মনসিংহ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্স থেকে পাকবাহিনীর লে. কর্নেল আমীর মোহাম্মদ খান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তির পরোয়ানা জারি করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বয়ং চাকরিচ্যুত হন এবং কয়েকজন শিক্ষক-কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির নির্দেশ আসে। তাঁরা হলেন- আলী নওয়াজ (বাংলা), শামসুজ্জামান খান (বাংলা), আব্দুর রাজ্জাক (বাংলা), এ বি এম নূরুল ইসলাম নাজমী (ইংরেজি), অধ্যাপক মোস্তফা হামিদ হোসেন (পদার্থবিদ্যা),আব্দুল বাকী — (উদ্ভিদবিদ্যা), এ আর এম মাসুম (পদার্থবিদ্যা), আব্দুল হক (উদ্ভিদবিদ্যা), আব্দুল হালিম (কৃষিশিক্ষা) এবং মুহাম্মদ হোসেন (পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক)।
ময়মনসিংহ সদরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট হাউস, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, গোলকিবাড়ি রোডের আলবদর কমান্ডার দিদারের বাসা এবং নতুন বাজারের রাজাকার আব্দুল হান্নানের বাসায় বিভিন্ন এলাকা থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতন শেষে অনেককে হত্যা করা হতো।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বধ্যভূমি ও গণকবরসমূহের মধ্যে ডাকবাংলো বধ্যভূমি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় বধ্যভূমি, নতুন বাজার বধ্যভূমি, কেওয়াটখালী রেলওয়ে কলোনি বধ্যভূমি, নিউমার্কেট বধ্যভূমি, কাচারিঘাট বধ্যভূমি, সাহেবপাড়া বধ্যভূমি, ছোটবাজার দুধমহাল কুয়া বধ্যভূমি, দাপুনিয়া বাজার ব্রিজ বধ্যভূমি এবং বড়বাজার কালীবাড়ি বধ্যভূমি ও গণকবর উল্লেখযোগ্য। ময়মনসিংহ নিউমার্কেট এলাকায় পাকসেনারা অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে ভেতরের গলিতে ফেলে দেয়। স্বাধীনতার পর সেখান থেকে অনেক কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। ময়মনসিংহ শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে কাচারিঘাটে একটি বধ্যভূমি ছিল। পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় এ ঘাটে শতশত বাঙালিকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের লাশ ব্রহ্মপুত্র নদে ফেলে দিত। ময়মনসিংহ শহরের সাহেবপাড়া কোয়ার্টারটি পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বধ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করত। স্বাধীনতার পরপর এ কোয়ার্টারের পুকুর থেকে বাক্সভর্তি অনেকগুলো কঙ্কাল পাওয়া যায়। ময়মনসিংহের ছোটবাজার দুধমহালে একটি কুয়া ছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনদের ধরে এনে হত্যা করে এই কুয়াতে ফেলে দেওয়া হতো। দাপুনিয়া বাজারে সুতিয়া নদীর ব্রিজে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী অসংখ্য সাধারণ মানুষকে ধরে এনে হত্যা করে সুতিয়া নদীতে ফেলে দেয়।
১৩ই জুলাই পাকবাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় নদীপথে গানবোটযোগে এসে বোরারচর গ্রামে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনীও পাল্টা আক্রমণ চালায়। প্রায় তিনঘণ্টাব্যাপী বোরারচর যুদ্ধএ দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন পাকসেনা আহত হয়। ময়মনসিংহ সদর থানার পরানগঞ্জে রাজাকাররা অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে অবস্থান করত। ২রা আগস্ট কমান্ডার মতিউর রহমান বেগের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এ ক্যাম্প আক্রমণ করলে রাজাকাররা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। ময়মনসিংহের পিয়ারপুরে মিলিশিয়াদের একটি ঘাঁটি ছিল। ২৭শে সেপ্টেম্বর কমান্ডার মতিউর রহমান বেগের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এ ঘাঁটি আক্রমণ করলে তারা পালিয়ে যায়। ময়মনসিংহ-বাহাদুরাবাদ ঘাটে ট্রেন চলাচল বন্ধের লক্ষ্যে মাইজল রেলওয়ে সেতুটি ধ্বংস করার প্রয়োজন ছিল। ১৫ই অক্টোবর নিকটবর্তী এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সালাম ফকিরের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সেতুটি ধ্বংস করে দেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ময়মনসিংহ সদরের নাওভাঙ্গারচরে পাকবাহিনীর কনভয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিতে আক্রমণ করেন। এতে পাকবাহিনীকে বহনকারী গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২৬শে নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা শম্ভুগঞ্জ রেলওয়ে সেতুতে পাহারারত রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালান। উভয় পক্ষে গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। ১০ই ডিসেম্বর ময়মনসিংহ সদর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেন- আব্দুল মান্নান, বীর বিক্রম (পিতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ, সুতিয়াখালী), আলিমুল ইসলাম, বীর প্রতীক (পিতা ইস্কান্দার আলী, কালিকাপুর) ও আলী আশরাফ, বীর প্রতীক (পিতা মো. আলী হায়দার)।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আনোয়ার হোসেন (পিতা বরকত উল্লাহ ভূঁইয়া, নিজকল্পা), ইদ্রিস আলী (পিতা চানকার আলী, ৪৪ নং বাঘমারা), ইদ্রিস আলী (পিতা ইছাহাক আলী সরকার, বাদেকল্পা), আব্দুল হাই (পিতা ডেঙ্গু বেপারী, বাদেকল্পা), চাঁন মিয়া (পিতা আব্দুল মোমেন, আকুয়া), আব্দুর রশিদ (পিতা আব্দুল কাদের ওরফে মমতাজ আলী, ১নং বাঘমারা), ছাইফুল ইসলাম (পিতা জোবায়েদ উল্লাহ, কাতলাসেন), আব্বাস আলী (পিতা আইয়ুব আলী, অষ্টাধর), আজগর আলী (পিতা সবদার আলী, অষ্টাধর), আলীমুদ্দিন (পিতা আইন উদ্দিন, অষ্টাধর), শাজাহান আলী (পিতা শহর আলী, কৃষ্টপুর), আলাউদ্দিন (পিতা শমসের আলী, কৃষ্টপুর), নেওয়াজ আলী (পিতা রেজত আলী, সিরতা), ফয়েজ উদ্দিন (পিতা জালাল উদ্দিন, চরনিলক্ষীয়া), নূরুল আমিন (পিতা জালালী, আজমতপুর), রইছ উদ্দিন (পিতা কিতাব আলী, আলগী), মকবুল হোসেন (পিতা সৈয়দ আলী, মির্জাপুর), নিজাম উদ্দিন (পিতা ইদ্রিস আলী, নয়াপাড়া), গোলাম রব্বানী (পিতা আহেদ আলী, বেগুনবাড়ি), আনোয়ার হোসেন (পিতা সৈয়দ সরকার, চরবরগিলা বাইলেন), আবু তাহের মুকুল (পিতা ওসমান গণি, ৪৭নং গোলকিবাড়ি), আলী হোসেন (পিতা জবেদ আলী, পলাশপুর মুক্তিযোদ্ধা পল্লী), রঞ্জিত কুমার গুপ্ত (পিতা নরেন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত, রূপাখালী), মুফতি মো. কাসেদ (পিতা ওয়াহিদ, ৪১নং শারদা ঘোষ রোড) ও আশরাফ আলী (পিতা ছলিম উদ্দিন আকন্দ, গোহাইলকান্দি)।
ময়মনসিংহ সদর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সে-সবের মধ্যে রয়েছে— সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্কোয়ার, ময়মনসিংহ শহর ‘বিজয়মোড় মুক্তিযুদ্ধ ভাস্কর্য’, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের নামসহ স্মৃতিস্তম্ভ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউস সংলগ্ন বধ্যভূমি স্মারক, শহীদদের স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য বিজয় ‘৭১, ময়মনসিংহ জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামসম্বলিত স্মৃতিফলক, আনন্দমোহন কলেজ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ এবং শহীদ আইনজীবীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিফলক। এছাড়া ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শহীদের নামে তিনটি হল নির্মিত হয়েছে। হল তিনটির নাম- শহীদ শামসুল হক হল, শহীদ নাজমুল আহসান হল ও শহীদ জামাল হোসেন হল। [আমিনুর রহমান সুলতান]
মণ্ডলভোগ রেলব্রিজ অপারেশন (বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ) পরিচালিত হয় অক্টোবর মাসের শেষদিকে। কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ও মানিখালী রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী জায়গায় মণ্ডলভোগ রেলব্রিজের অবস্থান। এ রেলব্রিজে রাজাকার ও মুজাহিদ- (আনসার) বাহিনীর ৫০ জনের একটি দল সব সময় পাহারায় নিয়োজিত থাকত। ব্রিজের পাশে রাজাকারদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। এ ব্রিজ ও ক্যাম্পের রাজাকার ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনটি পরিচালনা করেন।
মণ্ডলভোগের আঙ্গুর মিয়া ও সামসুদ্দিনের রেকিতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে হিলচিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে সভা করে এ এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত দল মণ্ডলভোগ ব্রিজের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ ও রাজাকার ক্যাম্প গুড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অক্টোবর মাসের শেষদিকে রিয়াজুল ইসলাম খান বাচ্চু, মোজাম্মেল হক আবির, মহিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ইয়াকুব আলী, আব্দুল মোতালিব বসু, কমান্ডার আব্দুল হাই ও কটিয়াদির মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের যৌথ নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জনের একটি দল এ আক্রমণ পরিচালনা করে।
মুক্তিযোদ্ধারা খুব ভোরে রেলব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে অবস্থান গ্রহণ করেন। প্রথমে এজজন মুক্তিযোদ্ধা এলএমজি দিয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করেন। সঙ্গে-সঙ্গে অন্যরা রাজাকারদের লক্ষ করে গুলিবর্ষণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণের পর রাজাকাররা কিছুক্ষণের মধ্যেই পাল্টা আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে তীব্র সম্মুখ যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ২০ জন আনসার ও রাজাকার ঘটনা স্থলে প্রাণ হারায়। কয়েকজন অস্ত্র ফেলে মানিকখালী রেলস্টেশনের দিকে পালিয়ে যায় এবং কয়েকজন ধরা পড়ে। আশপাশের গ্রাম থেকে উৎসুক জনতা এগিয়ে আসে এবং ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেয়া শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারা জনতার সহায়তায় রাজাকারদের ফেলে যাওয়া ২৫টি রাইফেল ও প্রচুর গোলা-বারুদ হস্তগত করেন। এ সময়ের ভেতরই মোজাম্মেল হক আবির ও হাসান আলী রেলব্রিজে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক স্থাপন করেন। ব্রিজের দুটি পিলারে সেফটি ফিউজে আগুন দেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ব্রিজটি প্রচণ্ড আওয়াজে বিধ্বস্ত হয়। জনতা বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে।
কিছুক্ষণ পর কিশোরগঞ্জ থেকে পাকবাহিনীর সেনা ও কিছু রাজাকার ট্রেনে করে ভাঙ্গা ব্রিজের উত্তর পাশে আসে। ট্রেন থেকে নেমে তারা অনবরত গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মোজাম্মেল হক আবির এলএমজি নিয়ে রেললাইনের পশ্চিম পাশে ধানের জমিতে পজিশন নেন। তাঁর সঙ্গে গুরই গ্রামের তমিজ উদ্দিন, মহিউদ্দিন আহমদ, রিয়াজুল ইসলাম খান বাচ্চুসহ আরো কয়েক জন অস্ত্রসহ পজিশনে যান। পাকসেনাদের বিরামহীন গুলিবর্ষণের সময় মুক্তিযোদ্ধারা কাদা-পানির মধ্যে ধানক্ষেতে ক্রলিং করতে-করতে হালিমপুর পর্যন্ত আসেন। বগামারা (১৬ই অক্টোবর) ও মণ্ডলভোগ রেলব্রিজে মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত আক্রমণ পরিচালনা মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ দুই সফল অপারেশনের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ও সংহতি বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে হানাদারদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। [মো. সিরাজুল ইসলাম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড