You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মহম্মদপুর উপজেলা (মাগুরা)

মহম্মদপুর উপজেলা (মাগুরা) বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিম অঞ্চলে মধুমতি-নবগঙ্গা বিধৌত মাগুরা জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি এলাকা। ১৯২৪ সালে এটি থানায় এবং ১৯৮৩ সালে এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ- বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে। মাগুরা থেকে এডভোকেট মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন এমএনএ, সৈয়দ আতর আলী এবং এডভোকেট মো. আছাদুজ্জামান এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে বিজয়ী হলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দেয়া হয়নি। নির্বাচনের ফলাফল নস্যাৎ করতে পাকিস্তানি সরকার ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। ফলে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় মাগুরা জেলার আপামর জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু যশোর জেলা সফরে এলে মুক্তিকামী জনতা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ন্যায় গর্জে ওঠে। এখানকার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পরবর্তী পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পেরে ব্যাপক গণসংযোগ শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর মাগুরা মহকুমার রাজনীতিবিদ ও মুক্তিকামী জনতা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ৮ই মার্চ মাগুরায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এডভোকেট মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন এমএনএ ও সৈয়দ আতর আলী এমপিএ সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা এবং এডভোকেট মো. আছাদুজ্জামান এমপিএ কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। একই সময়ে মহম্মদপুর থানা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- মো. রোস্তম আলী শিকদার, আব্দুর রশীদ বিশ্বাস, গোলাম ইয়াকুব, কাজী নূর মোস্তফা, মো. গোলাম রব্বানী, মো. নজরুল ইসলাম ওরফে নজির মিয়া, মো. আব্দুল ওয়াদুদ, মো. কাইউম মিয়া, মো. লুৎফর রহমান, মো. আইয়্যুব মিয়া, মো. কোবাদ আলী, মো. তফসির উদ্দিন, মো. আতিয়ার রহমান প্রমুখ। থানা কমিটি মহকুমা সংগ্রাম কমিটির নির্দেশক্রমে কার্যক্রম পরিচালনা করত। সংগ্রাম কমিটির ন্যায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে স্টুডেন্ট একশন কমিটি (স্যাক) গঠিত হয়। মাগুরায় ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হকের নেতৃত্বে এ কমিটিতে মহম্মদপুরের রোস্তম আলী, আলতাফ হোসেন প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সংগ্রাম কমিটি স্থানীয় মুক্তিকামী জনগণ, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্য এবং অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে থাকা সেনাসদস্যদের সমন্বয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরিকল্পনা করে। ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইট নামে হানাদার বাহিনীর গণহত্যার সংবাদ মহম্মদপুরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে সংগ্রাম কমিটি পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা প্রতিরোধের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এভাবে স্বাধীনতাকামী সকল শ্রেণির মানুষের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মহম্মদপুর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচিত হয়।
২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মহম্মদপুর উপজেলা সংগ্রাম কমিটি মুক্তিযুদ্ধের জন্য অবসরপ্রাপ্ত আনসার, পুলিশ ও সেনাসদস্য এবং স্থানীয় মুক্তিকামী জনতার সহায়তায় মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলে। ২৭শে মার্চ মাগুরা সংগ্রাম কমিটির সভায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্থানীয় ইয়াকুব বাহিনীর প্রধান আনসার কমান্ডার গোলাম ইয়াকুব, বীর প্রতীক এপ্রিল মাসে ২০-২২ জন আনসার, ইপিআর ও মুজাহিদ সদস্যদের নিয়ে মহম্মদপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৮টি রাইফেল ও ১টি রিভলবার ছিনিয়ে নেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার সমন্বয়ে ইয়াকুব বাহিনী নামে একটি শক্তিশালী বাহিনী গড়ে তোলেন। অপরদিকে অত্র এলাকার জামাই হিসেবে পরিচিত পুলিশ সদস্য কাজী নূর মোস্তফা (এএসআই) নহাটা অঞ্চলের ছাত্র- যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি এলাকার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি বাহিনী বাহিনী গড়ে তোলেন, যা পরবর্তী সময়ে জামাই বাহিনী নামে পরিচিত লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মো. আব্দুর রশীদ বিশ্বাস বিনোদপুরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এভাবে বিনোদপুর, মহম্মদপুর ও নহাটাসহ উপজেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। পরবর্তী সময়ে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণে ভারত গমন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে তাঁরা এলাকায় ফিরে এসে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এবং যুদ্ধে অংশ নেন।
৮ই মার্চ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত উপজেলা সংগ্রাম কমিটি মো. আছাদুজ্জামান এমপিএ-র নেতৃত্বে জনগণকে স্বাধীনতাযুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তাঁরা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে যুদ্ধবিষয়ক গান পরিবেশন, কবিতা ও নাটক উপস্থাপন এবং নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও মিছিল করে মুক্তিকামী জনতাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন।
মাগুরায় মুক্তিযুদ্ধের মূল সংগঠক ছিলেন এডভোকেট মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন এমএনএ, সৈয়দ আতর আলী এমপিএ এবং এডভোকেট মো. আছাদুজ্জামান গান এমপিএ। তাছাড়া ইয়াকুব বাহিনীর প্রধান আনসার কমান্ডার গোলাম ইয়াকুব এবং জামাই বাহিনীর প্রধান পুলিশের এএসআই কাজী নূর মোস্তফা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। পূর্বে উল্লিখিত সংগ্রাম কমিটির সদস্যবৃন্দ মহম্মদপুর থানায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাগুরায় শ্রীপুর উপজেলার আকবর বাহিনীর ন্যায় মহম্মদপুর উপজেলায়ও গোলাম ইয়াকুবের নেতৃত্বে ইয়াকুব বাহিনী- ও কাজী নূর মোস্তফা (জামাই)-র নেতৃত্বে জামাই বাহিনী গঠিত হয়, যা পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে। এ দুটি বাহিনী মহম্মদপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটিং সেন্টার, প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, যুদ্ধাস্ত্র সংরক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করত। এর পাশাপাশি অত্র এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন নকশাল বাহিনী হিসেবে খ্যাত চীনপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউিনিস্ট পার্টি (এমএল)-র সদস্যদের শ্রেণিশত্রু ও জোতদার হত্যা এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তৎপরতা বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপজেলা সদর, বিনোদপুর, নহাটাসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ইয়াকুব বাহিনী ও জামাই বাহিনীর জোর তৎপরতা অব্যাহত ছিল। ফলে হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা মহম্মদপুর উপজেলায় কখনো স্থায়ী ও দীর্ঘ মেয়াদি ক্যাম্প স্থাপন করতে পারেনি। তারা বিনোদপুর ও মহম্মদপুর সদরে ক্যাম্প স্থাপন করলেও সেখানে স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে পারেনি। উপরন্তু, গোলাম ইয়াকুব ও কাজী নূর মোস্তফার অবস্থান নহাটা এলাকায় হওয়ায় সেখানে পাকবাহিনী কোনো ক্যাম্পই স্থাপন করতে পারেনি। মহম্মদপুর উপজেলার নেতৃবৃন্দ স্থানীয় স্বাধীনতাকামী জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে মহম্মদপুরের প্রবেশদ্বার মাগুরা- মহম্মদপুর ও নড়াইল-মহম্মদপুর এলাকার সড়ক ও নৌপথে (নবগঙ্গা ও মধুমতি নদী পথ) শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নহাটা এলাকা ছিল মহম্মদপুর থানার মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রস্থল। গোলাম ইয়াকুব ও কাজী নূর মোস্তফার দুঃসাহসিক নেতৃত্বের সঙ্গে মো. আতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে গণবাহিনীর একটি দল এবং মো. আবুল খায়েরের নেতৃত্বে মুজিব বাহিনী-র আরেকটি দল যুক্ত হয়। তারা এ অঞ্চলে মেজর রিয়াজ খান ও ক্যাপ্টেন আজমলের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানি বাহিনী এবং চাঁদ আলী শিকদার ও আব্দুল রশিদ মোল্লার নেতৃত্বাধীন স্থানীয় রাজাকার বাহিনীকে শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হন। মুক্তিযোদ্ধারা মধুমতি নদী ও নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী স্থানে গোপনে অবস্থান করে নৌকা ও কার্গোযোগে নৌপথে হানাদার বাহিনীর আগমন প্রতিহত করার চেষ্টা করেন।
পাকিস্তানি বাহিনী ২৩শে এপ্রিল মাগুরায় এবং এপ্রিল মাসের শেষদিকে মহম্মদপুর উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। তারা বিনোদপুর ইউনিয়ন বোর্ড অফিস ও মহম্মদপুর টিটিডিসি হলে (উপজেলা সদর) ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ৪ বার নহাটা অঞ্চলে আক্রমণ করে। এ সময় হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নারীনির্যাতনের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করে।
পাকবাহিনী মাগুরা শহরে অনুপ্রবেশের পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মহম্মদপুরে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মে মাসের শুরুতে উপজেলায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এরপর আবুল হোসেন সিন্দাইনের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। মহম্মদপুর উপজেলায় শান্তি কমিটির নেতা মৌলবি মোসলেহ উদ্দিন, মৌলবি শামসুর রহমান, মৌলবি রজব আলি, গাজী খোরশেদুজ্জামান, রাজাকার চাঁদ আলী শিকদার, আব্দুল রশিদ মোল্লা, মো. মোসলেম মোল্লা, মো. সরোয়ার মিয়া, আ. ছালাম মাস্টার, মো. আবুল হোসেন প্রমুখ ছিল হানাদার বাহিনীর সহযোগী ও স্বাধীনতাবিরোধী। তাদের দেয়া তথ্য ও নির্দেশনার ভিত্তিতে পাকবাহিনী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ চলাত। তারা পাকবাহিনীর হত্যাকাণ্ড, বিভিন্ন হাট-বাজার ও বাড়ি-ঘর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি ও অবস্থান সম্পর্কে তথ্য প্রদান, নারীদের হানাদারদের হাতে তুলে দেয়াসহ বিভিন্ন অপকর্মে সহযোগিতা করত।
২৬শে এপ্রিল হানাদাররা বিনোদপুর পৌঁছে সেখানকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ধ্বংসের চেষ্টা করে। পাকবাহিনীর আগমন টের পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছোড়েন। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে এবং গণহত্যা চালায়। বিনোদপুর গণহত্যায় উচ্চ শিক্ষিত যুবক আব্দুর রাজ্জাকসহ ১৩ জন শহীদ হন। এ-সময় হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বিনোদপুরে বিভিন্ন বাড়িঘরে লুটপাট চালায়। ২৬শে জুলাই পাকবাহিনী নহাটা অঞ্চল আক্রমণ করে নহাটা বাজার ও পার্শ্ববর্তী নারান্দিয়া গ্রামে ২৫- ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। নহাটা বাজারে অগ্নিসংযোগকালে পাচু বিশ্বাস নামে একজন আগুনে পুড়ে মারা যায়। তারা অরুণ বোসকে ধরে কানের ভেতর রাইফেলের নল ঢুকিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও তাদের গুলিতে নহাটায় একজন পুলিশ সদস্যসহ ৪ জন শহীদ হন। এ-সময় তারা নারান্দিয়া ও বেজড়া গ্রামে গণহত্যা চালায়। নারান্দিয়া-বেজড়া গণহত্যায় ৫ জন মানুষ শহীদ হন। মহম্মদপুর যুদ্ধে শহীদ দুই সহোদর ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মা বলে চিৎকার দেয়ার ঘটনা ছিল খুবই হৃদয় বিদারক। বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র নহাটা বাজারে হানাদার বাহিনী ৩ বার অগ্নিসংযোগ করে মালপত্রসহ দোকানপাট সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। এ অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের শিকার কয়েকজন নারী দুর্বিষহ জীবন নিয়ে আজো বেঁচে আছেন। মহম্মদপুর উপজেলা সদরে অবস্থিত টিটিডিসি হল (উপজেলা পরিষদ ভবন) এবং বিনোদপুর ইউনিয়ন বোর্ড অফিস ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার চাঁদ আলী শিকদার, আবুল হোসেন সিন্দাইন ও আব্দুর রশিদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে এনে নির্যাতন করত।
মহম্মদপুর উপজেলার বিনোদপুর বাজারঘাট ছিল পাকবাহিনীর বধ্যভূমি। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষদের ধরে এনে বিনোদপুর গোপন ক্যাম্পে নির্যাতন করত। অতঃপর বাজারঘাটে এনে গুলি করে হত্যা শেষে মৃতদেহ নবগঙ্গা নদীতে নিক্ষেপ করত। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এখানে একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বিনোদপুর বাজারঘাট বধ্যভূমিতে শহীদ শতাধিক জনের মধ্যে ১৩ জনের পরিচয় পাওয়া যায়। দূর-দূরান্তের অনেক মানুষ শহীদ হওয়ায় তাদের পরিচয় জানা যায়নি। মোহাম্মদপুর উপজেলায় কোনো গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায় না|
মহম্মদপুর উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে নহাটা যুদ্ধ, বিনোদপুর যুদ্ধ, জয়রামপুর যুদ্ধ ও মহম্মদপুর যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
২১শে আগস্ট নহাটায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন মুক্তিযোদ্ধা গোলাম ইয়াকুব ও কাজী নূর মোস্তফা। ভয়াভয় এ-যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য নিহত হয়। এছাড়াও ৪টি ৩০৩ চাইনিজ রাইফেল, ২টি ওয়ারলেস সেট, ১টি ৭৬২ চাইনিজ রাইফেলসহ প্রায় ২০০ রাউন্ড গুলি ও প্রচুর গোলাবারুদ হস্তগত হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি নূরুল হক (পুলিশ সদস্য) শহীদ হন।
৪ঠা অক্টোবর বিনোদপুরে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এ-যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার বদরুল আলম, আ. রাজ্জাক মন্ডল, জহুর- ই-চৌধুরী, জহুরুল আলম মুকুল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। অপরপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল আলম মুকুল শহীদ হন এবং হাবিলদার মোস্তফা আহত হন। বাবুখালি ইউনিয়নের বহলবাড়িতে রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ২ জন রাজাকার নিহত হয় এবং কয়েকজন আত্মসমর্পণ করে।
১৬ই অক্টোবর নহাটা ইউনিয়নের জয়রামপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। কমান্ডার গোলাম ইয়াকুবের নেতৃত্বে এ-যুদ্ধে কাজী নূর মোস্তফা, নজির নায়েব, আব্দুর রশিদ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন। যুদ্ধে অর্ধশতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং আবির হোসেন নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১৯শে নভেম্বর মহম্মদপুর সদরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের এ-যুদ্ধে গোলাম ইয়াকুব, কাজী নূর মোস্তফা, আহম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন, মো. রোস্তম আলী শিকদার, আব্দুর রশীদ বিশ্বাস, মো. আব্দুল হাই মণ্ডল, এডভোকেট আবুল খায়ের প্রমুখ এ-যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধে রাজাকারসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্য নিহত হয়। এ-যুদ্ধে দুই সহোদর মুক্তিযোদ্ধা আহম্মদ হোসেন ও মোহাম্মদ হোসেন, রফিউদ্দিন এবং ইপিআর সদস্য মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন।
নহাটা জয়রামপুর ও মহম্মদপুরের ৩টি যুদ্ধের সংবাদ ~স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র−, আকাশবাণী কলকাতা, অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং বিবিসি- লন্ডন থেকে প্রচারিত হয়। এছাড়াও হানাদার বাহিনী, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর বাহিনী ও নকশাল বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের উপজেলা সদর, যশোবন্তপুর, ডাঙ্গাপাড়া, পানিঘাটা প্রভৃতি স্থানে খণ্ড-খণ্ড যুদ্ধ হয়।
৫ই ডিসেম্বর গোলাম ইয়াকুব ও তার সহযোগীরা মহাম্মদপুরে পুলিশ ও রাজাকারদের আক্রমণ করার উদ্যোগ নিলে উপজেলার রেঞ্জার পুলিশ, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ঐদিনই মহম্মদপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার (অব.) মো. জালাল উদ্দিন, বীর উত্তম- (পিতা মো. ইসমাইল মোল্লা, পলাশবাড়িয়া) ও আনসার বাহিনীর কমান্ডার মো. গোলাম ইয়াকুব, বীর প্রতীক (পিতা জমির উদ্দিন মোল্লা, নারানদিয়া, নহাটা)।
মহম্মদপুর উপজেলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— আবির হোসেন (পিতা মো. মনসুর মোল্লা, কাশিপুর; জয়রামপুরে যুদ্ধে শহীদ), দুই সহোদর মোহাম্মদ হোসেন ও আহম্মদ হোসেন (পিতা আফসার উদ্দিন মোল্লা, নাগড়িপাড়া; মহম্মদপুর যুদ্ধে শহীদ), মো. রফিউদ্দিন (পিতা মো. আব্দুর রহমান মোল্লা, কাশিপুর; মহম্মদপুর যুদ্ধে শহীদ), ইপিআর সদস্য আহম্মেদ আলী (রূপদিয়া, যশোর; মহম্মদপুর যুদ্ধে শহীদ), পুলিশ সদস্য মুন্সী নূরুল হক (পিতা মুন্সী গোলাম হোসেন, নহাটা), মো. জহুরুল আলম মুকুল (পিতা শেখ বদরউদ্দিন আহম্মদ, আমতৈল, শ্রীপুর; বিনোদপুর যুদ্ধে শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বিনোদপুর বাজারে শহীদ জহুরুল আলম মুকুল স্মৃতিভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। মহম্মদপুর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে বঙ্গবন্ধু, শহীদ হাবিবুর রহমান, দুই সহোদর মোহাম্মদ হোসেন ও আহম্মদ হোসেন এবং আবির হোসেন স্মরণে স্মৃতিভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান এমপিএ স্মরণে নির্মিত হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান স্টেডিয়াম ও আছাদুজ্জামান মিলনায়তন (মাগুরা সদর)। মাগুরা ভায়না মোড় থেকে ঢাকা রোড (মাগুরা সদর) পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান সড়ক। মহাম্মদপুরে স্থাপিত হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান কলেজ (জোকা), বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান পাঠাগার (জোকা), বীর মুক্তিযোদ্ধা আছাদুজ্জামান পুলিশ বক্স (ওয়াপদা, মাগুরা) ও আছাদুজ্জামান মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন (ফুলবাড়ি)। নহাটায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ নূরুল হক সড়ক। এখানে স্থাপিত হয়েছে শহীদ নূরুল হক স্মৃতিফলক। ঢাকার বনানীতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর উত্তম লে. কমান্ডার (অব.) জালাল উদ্দিন সড়ক। উপজেলা সদরে নির্মিত হয়েছে বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকুব মিয়া মার্কেট। নহাটায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর প্রতীক গোলাম ইয়াকুব সড়ক। বিনোদপুরে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশিদ সড়ক। চাকুলিয়ায় একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আ. ছাত্তার জোয়াদ্দার সড়ক। উপজেলা সদরে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মহাম্মদ-আহম্মদ সড়ক। উপজেলা সদরে নির্মিত হয়েছে শহীদ আহম্মদ-মোহাম্মদ মার্কেট, শহীদ রওশন মার্কেট, শহীদ আবির সাধারণ পাঠাগার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবির হোসেন প্রাথমিক বিদ্যালয় (কাশিপুর)। বিনোদপুরে নির্মিত হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মুকুল পাঠাগার। [সৈয়দ হাদিউজ্জামান]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!