বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মনোরঞ্জন ধর
মনোরঞ্জন ধর (১৯০৪-২০০০) বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, বিভাগ-পূর্ব বাংলায় কংগ্রেসের অন্যতম নেতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দীর্ঘ কারাবরণকারী, পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক, ভাষা-সংগ্রামী ও কারাবরণকারী, মুক্তিযুদ্ধকালে গঠিত সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ (Consultative Committee)-এর অন্যতম সদস্য এবং স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি ১৯০৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার চাতল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগৎচন্দ্র ধর ও মাতার নাম সৌদামিনী ধর। তিনি স্থানীয় আচমিতা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে আইএসসি পাশ করেন। কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তিনি বিএ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে এমএ ও পরবর্তীতে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তরুণ বয়সে তিনি বাংলার বিপ্লবীদের সংগঠন ‘যুগান্তর’-এ যোগ দেন। ১৯২১ সালে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং দীর্ঘদিন তিনি কারাগারে কাটান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে মোট ১৮ বছর তিনি কারাবরণ করেন। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনে কংগ্রেস থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ভারত বিভক্তির পর তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রে জাতীয় কংগ্রেস দল গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন এ দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫২-র ভাষা-আন্দোলন কালে তিনি আইন পরিষদের ভেতরে ও বাইরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত ও নিহত ছাত্রদের তিনি দেখতে যান এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আইন পরিষদে নুরুল আমিন সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন। একই সঙ্গে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির জোর দাবি জানান। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের কারণে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। প্রথমে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে, পরে সেখান থেকে রংপুর এবং সর্বশেষ পাবনা কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।
১৯৫৩ সালের শেষের দিকে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থাধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৬-১৯৫৮ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারে কংগ্রেস থেকে তিনি অর্থ ও সংখ্যালঘু দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি কয়েকজন রাজনীতিক সহকর্মীকে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের মেঘালয়ে যান। সেখান থেকে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শ দানে সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর নেতৃত্বে গঠিত সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের তিনি অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত সরকারের তিনি আইন, সংসদ ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঐ পদে বহাল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। ২০০০ সালের ২২শে জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: মাহফুজা খানম ও তপন কুমার দে, গণমানুষের মুক্তির আন্দোলনে, দ্বিতীয় খণ্ড, ঢাকা ২০১০; বশির আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ঢাকা, আগামী প্রকাশনী ২০০৩
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড