মনোহরদী থানা অপারেশন (নরসিংদী)
মনোহরদী থানা অপারেশন (নরসিংদী) পরিচালিত হয় ৮ই জুলাইয়ের পর। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের ক্যাম্প দখল করে নেন। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কয়েকজন পাকসেনা বন্দি হয়। তাদের মধ্যে ৭ জন বাদে বাকিরা উত্তেজিত জনতার হাতে নিহত হয়।
মনোহরদী থানা হানাদার ক্যাম্প দখল ছিল অত্র এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের এক বিশাল বিজয়। ঘটনার দিন রাতে মুক্তিযোদ্ধারা সেহেরি খেয়ে যাত্রা শুরু করেন। ইতোমধ্যে মনোহরদী থানার বিভিন্ন দূরবর্তী স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের খণ্ডখণ্ড গ্রুপ মনোহরদীতে আসতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ওসমান, কাজী আকমল ও মো. আবদুল হাকিম সমবেত মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশে সংক্ষেপে কিছু কথা বলার পর যাত্রা শুরু হয়। এরপর তাঁরা মনোহরদী বাজারের পাগল নাথেরি আখড়া থেকে আহম্মদ মার্কেট হয়ে মনোহরদী কলেজের পূর্ব পাশ দিয়ে লাল মিয়া মিলিটারির বাড়ি পর্যন্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। আহাম্মদ মার্কেটে ৩ ইঞ্চি মর্টার স্থাপন করা হয়। মেশিনগান বসান হয় মনোহরদীর সুইচ গেটের কাছে। কাজী ওসমান (ওসমান সাহেব নামেও পরিচিত) পুরো রণাঙ্গন ঘুরে দেখে এসে সকাল ৯টার দিকে ফায়ারিং ওপেন করেন। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ। স্থানীয় মুক্তিবাহিনী একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা গ্রহণপূর্বক এলাকার জনগণের সহায়তায় উক্ত তারিখে থানার সব রাস্তা ব্লক করে দিয়ে ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীও নিজেদের রক্ষার জন্য বৃষ্টির মতো প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু করে। সারাদিন ধরে গোলাগুলি চলে। সন্ধ্যার ঘণ্টা খানেক পর ক্যাম্প থেকে আর কোনো গুলির আওয়াজ আসছিল না। ইতোমধ্যে পাকবাহিনীর কমান্ডার কিছু সংখ্যক সৈন্য নিয়ে অন্ধকারে পলায়ন করতে সক্ষম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রাতেই ক্যাম্প ঘেরাও করে ঝুঁকি গ্রহণপূর্বক ভেতরে ঢোকেন। সেখানে আহত ও নিহতরা পড়েছিল। লুকিয়ে থাকা ৭ জন পাকসেনাকে জীবিত ধরে ফেলেন মুক্তিযোদ্ধারা। বন্দি পাকসেনারা হাতিয়ার ফেলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট জীবন ভিক্ষা চায়। মুক্তিবাহিনী রাতে এলাকার সব রাস্তাতেই ডিউটি বসানোর ব্যবস্থা করে। সকালে খবর পাওয়া যায়, পলাতক পাকসেনারা শেখের বাজারের দিকে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনী দ্রুত তাদের পিছু নেয় এবং নিকটে গিয়ে ‘হল্ট’ করতে বলে। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য পাকসেনারা আর এগোয়নি। সঙ্গে-সঙ্গে হল্ট হয়ে যায়। হাতিয়ার মাটিতে ফেলে দিয়ে তারা তাৎক্ষণিক আত্মসমর্পণ করে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে হাজার-হাজার মানুষ এসে জড়ো হয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকে এবং বন্দি পাকসেনাদের ঘিরে ফেলে। উপস্থিত জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা শোনেনি। তারা বন্দিদের ছিনিয়ে নেয়। তীব্র রোষে তাদের ওপর চড়াও হয়ে সবাইকে মেরে ফেলে। ইতঃপূর্বে বন্দি ৭ জন পাকসেনাকে মুক্তিবাহিনী স্কোয়াড করে চালাকচরের দিকে পাঠিয়ে দেয় কোথাও লুকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু এলাকার জনগণ তাদের অত্যাচারে এতই অতিষ্ঠ ছিল যে, তারা খুবই মারমুখি হয়ে ওঠে। পরদিন সকাল ১০টার দিকে চালাকচর হাইস্কুল মাঠে পাকসেনাদের দেখানো হবে মর্মে ঘোষণা দিলে জনগণ একটু শান্ত হয় এবং হাজার-হাজার মানুষ তখন বাড়ি ফিরে যায়। পরদিন ২ জন পাকসেনাকে ড্রেস পরিয়ে অতি সতর্কতার সঙ্গে গার্ড দিয়ে চালাকচর হাইস্কুল মাঠে নিয়ে যায় মুক্তিবাহিনী। পরে তাদের বন্দি অবস্থায় অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়। [এম আর মাহবুব]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড