You dont have javascript enabled! Please enable it!

অবাঙালি, নিষ্ঠাবান ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ খান পাঠান

মমতাজ খান পাঠান অবাঙালি, নিষ্ঠাবান ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর পিতার নাম মহব্বত খান এবং মাতার নাম জেবার জান। তিনি ১৯৩৬ সালের ১লা জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা পাঁচ ভাই-বোন। তাঁর অগ্রজ দুই ভাই হলেন খুরশিদ খান ও বশির খান। পাকিস্তানের পেশোয়ারের মর্দান জেলায় তাঁদের পৈতৃক নিবাস। সেখানে মমতাজ খানের প্রথম স্ত্রী ও এক ছেলে আছেন। মমতাজ খান লেখাপড়া খুব বেশি করেননি।
মমতাজ খান প্রথম বাংলাদেশে আসেন ১৯৬০ সালে, এদেশ দেখতে। তারপর বড়ভাই খুরশিদ খান ও চাচাত ভাই উজির মোহাম্মদ খানের সঙ্গে টাঙ্গাইলের সখিপুরের শালগ্রামে বিড়ির ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে তেন্ডুলপাতা দিয়ে বিড়ি তৈরির তাঁদের একটি কারখানা ছিল। কারখানায় প্রায় চার হাজার বাঙালি শ্রমিক কাজ করত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মমতাজ খানের ভাইয়েরা পাকিস্তানে চলে যান, কিন্তু তিনি থেকে যান। কারণ বাঙালিরা তাঁকে খুব ভালোবাসত। তিনিও তাদের ও এদেশকে ভালোবেসেছেন। এভাবে তাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
মমতাজ খানের এক চাচাত ভাই ইশফাক খান ছিলেন পাকবাহিনীর কর্নেল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রধানত টঙ্গী এলাকার দায়িত্বে ছিলেন। তবে ঢাকায়ও দায়িত্ব পালন করতেন।
বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তম-এর সঙ্গে মমতাজ খানের আগে থেকেই কিছুটা পরিচয় ছিল। যুদ্ধের শুরুর দিকে পাকবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগে তাঁকে একবার কাদের সিদ্দিকীর বাড়িতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় কাদের সিদ্দিকী তাঁকে ছেড়ে দেন এবং তখন থেকে তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। এমনকি মমতাজ খান কাদের সিদ্দিকীর বাবা- মাকে নিজের বাবা-মা’র মতো জ্ঞান করতেন। এই সূত্র ধরে মমতাজ খান এক সময় মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর কাজ ছিল মূলত আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ওষুধ সরবরাহ করা এবং পাকবাহিনীর খবরাখবর মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট পৌছে দেয়া। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত তিনি এ কাজ করেছেন। তিনি ঢাকার মিটফোর্ড ও করাচি থেকে ওষুধ আনতেন। নিজের টাকায় বিমানে করাচি যেতেন এবং ঢাকা বিমান বন্দরে এসে কর্নেল ইশফাকের গাড়িতে করে ওষুধ নিয়ে যেতেন। তাই কেউ তাঁকে সন্দেহ করত না। এমনকি তাঁর কর্নেল ভাইও এ ঘটনা জানতেন না। তাঁর কারখানার শ্রমিকদের কথা বলে তিনি এ ওষুধ আনতেন। এভাবে তিনি একাধিকবার করাচি থেকে ওষুধ এনেছেন।
পাকবাহিনী একবার মমতাজ খানকে ওষুধসহ আটক করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে নির্যাতন করে। পরে কর্নেল ইশফাকের সুপারিশে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়। পাকবাহিনীর প্রহারে তাঁর পেটে রক্ত জমে যায় এবং টাঙ্গাইলের ডা. শাহজাদা চৌধুরী তাঁর অপারেশন করেন।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে মমতাজ খান একবার কর্নেল ইশফাকের ক্যান্টনমেন্টের বাসায় যান। সেখানে অন্য কারো সঙ্গে কর্নেলের টেলিফোন আলাপ থেকে তিনি জানতে পারেন যে, চাঁদপুর থেকে অস্ত্রবোঝাই দুটি জাহাজ টাঙ্গাইলে যাচ্ছে। এ খবর শুনে তিনি টাঙ্গাইল চলে যান এবং তাঁর কারখানার ম্যানেজার খের মোহাম্মদকে দিয়ে একটি চিরকুট লিখিয়ে নিজে কাদের সিদ্দিকীর কাছে গিয়ে জাহাজ আসার খবর দেন। এ খবরের ভিত্তিতে ১১ই আগস্ট কাদের সিদ্দিকীর নির্দেশে কমান্ডার মো. হাবিবুর রহমান, বীর বিক্রম (জাহাজমারা হাবিব) টাঙ্গাইলের সিরাজকান্দিতে ঐ জাহাজ আক্রমণ করেন, যা জাহাজমারার যুদ্ধ নামে বহুল পরিচিত। হাবিবুর রহমান মমতাজ খানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মমতাজ খানের দুবার সাক্ষাৎ হয়— একবার টাঙ্গাইলে, আরেকবার ঢাকায় বেইলি রোডে। কাদের সিদ্দিকীই এ সাক্ষাৎ করিয়ে দেন।
মমতাজ খান স্বাধীনতার ১৫ দিন পর পুরান ঢাকার আগামসী লেনের ৫৩ নম্বর বাড়ির বাঙালি মেয়ে রোকসানাকে বিবাহ করেন। তাঁদের দুই ছেলে- এজাজ খান ও আওরঙ্গজেব খান (মৃত) এবং দুই মেয়ে অদ্দোহা খান (কাকলী) ও তাহমিনা খান। দুই মেয়েই বিবাহিতা এবং তাদের স্বামীরা বাঙালি মমতাজ খান আগে পুরান ঢাকার আগামসী লেনে থাকতেন। তাঁর বর্তমান ঠিকানা: ১৩/১০, ব্লক-ই, কাজী নজরুল ইসলাম রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁর নামে এ বাসাটি বরাদ্দ করেন।
যুদ্ধের সময় মমতাজ খানের ব্যবসা আগের মতো চলত না। পরে একবারেই বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পরে তিনি ছোটখাটো কাজ করে সংসার চালাতেন। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৬ বছর। আহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সরকারি ভাতা পান। [হারুন-অর-রশিদ ও মনিরুজ্জামান শাহীন]
তথ্যসূত্র: মমতাজ খান পাঠানের বাসভবনে ০২-১০-১৫ তারিখে গৃহীত তাঁর সাক্ষাৎকার; কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম, স্বাধীনতা ‘৭১, অনন্যা, ঢাকা ২০০৯, পৃ. ২৫০, ২৬০-১; Dr. Nuran Nabi, Bullets of ’71: A Freedom Fighter’s Story, AuthorHouse, USA 2011, pp. 323-4

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!