মুক্তিযুদ্ধে মনপুরা উপজেলা (ভোলা)
মনপুরা উপজেলা (ভোলা) ছিল তজুমদ্দিন থানার অন্তর্গত। ১৯৭০ সালে এটি পৃথক থানার মর্যাদা পায়। এর পূর্বদিকে নোয়াখালী, পশ্চিমে ভোলা, উত্তরে মেঘনা নদী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে এখানে আসার একমাত্র উপায় নৌপথ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় মনপুরা জাতীয় পরিষদে ভোলা-২ নির্বাচনী এলাকা এবং প্রাদেশিক পরিষদে দৌলতখান থানার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখন জাতীয় পরিষদে ডা. আজহার উদ্দিন এবং প্রাদেশিক পরিষদে মো. নজরুল ইসলাম সদস্য নির্বাচিত হন। এ বছরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে মনপুরায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এই বিপর্যয়ের পরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনপুরার সাধারণ মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে এলে দ্বীপবাসী তাঁর সরাসরি সংস্পর্শে আসে।
নির্বাচনের পর পাকিস্তানি সামরিক জান্তা আওয়ামী লীগ- ও বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় সারাদেশের মতো মনপুরায়ও গণবিক্ষোভ দেখা দেয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে —অসহযোগ আন্দোলন-এর সকল কর্মসূচি এখানে পালিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মনপুরায় আওয়ামী লীগ নেতা বসারত উল্লাহ চৌধুরী (পিতা আবু আলফাজ চৌধুরী)- র নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের অন্য সদস্যরা ছিলেন- আলী মিয়া মাস্টার (সাকুচিয়া), সিরাজুল ইসলাম (হাজীরহাট), আব্দুল হাই (কাউয়ার টেক; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র), মো. লিয়াকত হোসেন (পিতা হাজী আব্দুল মতলব পাটোয়ারী, কাউয়ার টেক), হাফিজ উল্লাহ চৌধুরী (আন্দিরপার), নুরুল ইসলাম ওরফে মানিক মিয়া (কুলাগাজীর তালুক), মো. শামছুদ্দিন চৌধুরী (পিতা আবু নাছের চৌধুরী, আন্দিরপার), এ এল এম সারেমুল হক (পিতা আমির হোসেন মিয়া, আন্দিরপার), মো. আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া (পিতা হাজী জব্বার ভূঁইয়া, কুলাগাজীর তালুক) এবং নগেন্দ্র মাস্টার (বকশির হাওলা)। সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একাধিক জনসভা করে জনগণকে সংগঠিত করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পরিষদের নেতৃবৃন্দ সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন।
মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রস্তুতি শুরু করে এবং যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য যুবকদের উৎসাহিত করে। জুন মাসের শেষদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়। বসারত উল্লাহ চৌধুরীর বাড়ির পার্শ্ববর্তী আশুনীর মা- র বাড়িতে খোলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নেন। তাঁরা হলেন- মো. শামছুদ্দিন চৌধুরী, এ এল এম সারেমুল হক, মো. লিয়াকত হোসেন, মো. গোফরান মিয়া (পিতা হাজী আব্দুল মতলব পাটোয়ারী, কাউয়ার টেক), আব্দুল হাই (পিতা আব্দুল হাদি), মো. আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া, মো. মফিজ উল্লাহ চৌধুরী (পিতা মৌলবী আকরাম আলী চৌধুরী), মো. আমজাদ হোসেন (পিতা মো. মশিয়র রহমান), মো. সালাহ উদ্দিন (পিতা আব্দুর রাজ্জাক), মো. আমিরুল ইসলাম (পিতা আমান উল্লাহ হাওলাদার), মো. বেলাল উদ্দিন (পিতা মজির উদ্দিন মাস্টার), বসারত উল্লাহ চৌধুরী, মো. আলাউদ্দিন (পিতা মোহাম্মদ হোসেন), শ্রীদাম চন্দ্র দাস (পিতা মহিম চন্দ্ৰ দাস), ছালেহ উদ্দিন চৌধুরী (পিতা আবু নাছের চৌধুরী), মো. রফিকুল ইসলাম রতন (পিতা মৌলবী সুলতান আহাম্মদ), আব্দুল মান্নান (পিতা হাবিব আহাম্মদ), মো. হেলাল উদ্দিন চৌধুরী (পিতা মো. আবু আজম বাশার চৌধুরী), মো. শামছুল হক (পিতা আবু হোসেন), মো. নুর আলম (পিতা তছিল আহাম্মদ), আব্দুল হালিম চৌধুরী (পিতা আব্দুল বারী চৌধুরী), আবুল খায়ের (পিতা শামছুল হক হাওলাদার), মো. ফারুক (পিতা সামছুল হক), মো. সাইফুল উল্লাহ হাওলাদার (পিতা আলহাজ্ব আব্দুল কাদের), মো. আব্দুল হাই মিয়া (পিতা হারিছ আহাম্মদ মিয়া), মো. সফি আলম (পিতা আব্দুস সহিদ), মো. মাইন উদ্দিন (পিতা আশ্রাফ আলী পাটোয়ারী), মো. ফারুক (পিতা শাহজাহান মিয়া), মো. আবুল বাশার (পিতা হারিছ আহাম্মদ মিয়া), মো. আবু তাহের (পিতা শামছুদ্দিন পণ্ডিত), মো. আব্দুল কাদের (পিতা মোয়াজ্জেম হোসেন), অনুকূল চন্দ্র দাস (পিতা কৈলাশ চন্দ্ৰ দাস), আলহাজ্ব মো. সিরাজুল ইসলাম (পিতা আব্দুল মান্নান ফরাজী), আলহাজ্ব আব্দুল মন্নান (পিতা দেলোয়ার হোসেন), আবুল কাশেম মাতব্বর (পিতা তোফাজ্জল হোসেন), মো. নাছির আহাম্মদ (পিতা জালাল আহাম্মদ ফরাজী), আবুল কাশেম আজাদ (পিতা আনছারুল হক), মো. শামসুল আলম নোয়াব (পিতা আব্দুল মান্নান), আব্দুল হাই (পিতা হাজী মো. হোসেন), মোকলেছুর রহমান (পিতা বদিউর রহমান), মজিবুল হক পাটোয়ারী (পিতা আব্দুল আলী মুন্সী), মো. মজির উদ্দিন (পিতা মুজাফফর আহাম্মদ), মো. মহিউদ্দিন (পিতা আব্দুল আলী মুন্সী), মো. হারিছ আহাম্মদ (পিতা আবুল কাশেম), সুধাংশু মোহন দাস (পিতা রামপ্রসাদ দাস), এম এ কাশেম (পিতা এম এ মজিদ মুন্সী), সফিকুল ইসলাম (পিতা আব্দুল মতিন ফরাজী), সিরাজ উদ্দিন হাওলাদার (পিতা হারিছ আহাম্মদ), মো. সিরাজ উদ্দিন (পিতা আব্দুল বারেক পাটোয়ারী), সাইফুল ইসলাম (পিতা দেলোয়ার হোসেন), প্রিয়লাল দাস (পিতা অনন্ত কুমার দাস) প্রমুখ। প্ৰশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সামসুদ্দিন চৌধুরী বাচ্চু, মফিজুল ইসলাম (রেপন), শম্ভু কর্মকার (চর ফ্যাশন) এবং মফিজুল্লাহ চৌধুরী (সেনাসদস্য)। এখানে এসএলআর, এসএমজি, এলএমজি, থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, গ্রেনেড, বেয়নেট ইত্যাদি সমরাস্ত্রের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ, ব্রিজ- কালভার্ট ধ্বংসসহ যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল শেখানো হয়। পাকবাহিনী ৬ই মে ভোলায় প্রবেশ করার পর অসংখ্য মানুষ জীবন রক্ষার জন্য মনপুরায় আশ্রয় নেয়। আশ্রয় গ্রহণকারী এসব মানুষ ও নিজেদের রক্ষা এবং পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য মনপুরার মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা নদীর তীরে বাংকার তৈরি করে এবং রাতে মশাল জ্বালিয়ে পাহারা বসান। সাধারণ মানুষ ভোলা থেকে পাকবাহিনীর লঞ্চ বা নৌকা আসে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করে। তারা সব সময় দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শত্রুদের প্রতিরোধে সতর্ক অবস্থান নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনীর আক্রমণ না ঘটায় মনপুরায় কোনো প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়নি। তবে মনপুরার মুক্তিযোদ্ধারা অক্টোবরের শেষদিকে ভোলায় গিয়ে ভোলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মনপুরায় স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগ- ও জামায়াতে ইসলামী-র লোকজন ছিল, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের সতর্ক অবস্থানের কারণে তারা প্রত্যক্ষভাবে কোনো তৎপরতা চালাতে পারেনি। এখানে পাকবাহিনী বা তাদের দোসরদের কোনো ক্যাম্প ছিল না। তাই এ উপজেলা ছিল মুক্তাঞ্চল।
স্বাধীনতার পর মনপুরার মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কয়েকটি সড়কের নতুন নামকরণ করা হয়েছে। যেমন রামনেয়াজ থেকে মিয়া জমস্যা পর্যন্ত সড়কের নাম হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা বসারত উল্লাহ চৌধুরী সড়ক’, হাজীর হাট থেকে বাঁধের হাট-বাজার পর্যন্ত সড়কের নাম হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ মাস্টার সড়ক’, মিয়া জমস্যা সড়ক থেকে চৌধুরী প্রজেক্ট পর্যন্ত সড়কের নাম হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা সালাউদ্দিন সড়ক’, চৌধুরী বাজার থেকে পূর্বদিকের রাস্তার নাম হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের চাষী সড়ক’ এবং কুলাগাজীর তালুক থেকে পূর্বদিকের রাস্তার নাম হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের সড়ক’। [মো. আলাউদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড