You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর প্রতীক মনির আহমেদ খান - সংগ্রামের নোটবুক

বীর প্রতীক মনির আহমেদ খান

মনির আহমেদ খান, বীর প্রতীক (১৯৩৮-২০১২) সুবেদার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৩৮ সালের ২০শে জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার দেলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আলী আহমেদ খান এবং মাতার নাম রহিমা বেগম। ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৫ম। তিনি কসবা হাইস্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। মনির আহমেদ খান ১৯৫৫ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র অবস্থায় তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হন এবং সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
তিনি প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটি সাব-সেক্টরের ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিমের নেতৃত্বে আশুগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং পরে ‘এস’ ফোর্সে ১১শ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে আখাউড়া পতনের পর তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরার নিকটবর্তী ইসলামপুরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে চরম সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দেন। ৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা চান্দুরার দিকে আগ্রসর হন। এ অগ্রাভিযানে সবার আগে মার্চ করে ‘সি’ গ্রুপ এবং তাঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল দ্রুত এগিয়ে গিয়ে শাহবাজপুর সেতু দখল করা। ‘সি’ গ্রুপকে অনুসরণ করে ‘এ’ গ্রুপ এবং তারপর ‘ডি’ গ্রুপ। সবার পেছনে ছিল ‘বি’ গ্রুপ। কাট- অফ-পার্টি হিসেবে তাঁদের ওপর নির্দেশ ছিল অগ্রসরমাণ মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তা বিধান করা। এ অগ্রাভিযানে মনির আহমেদ খান ছিলেন ‘সি’ গ্রুপে। এদিন ‘এস’ ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল (তখনকার র্যাংক) কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম – মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি যখন চান্দুরার নিকটবর্তী ইসলামপুরে পৌঁছেন, তখন হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাভর্তি দুটি ট্রাক সেখানে এসে থামে। কে এম সফিউল্লাহ তাৎক্ষণিক পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পাকিস্তানি সেনারা হাত উঁচু করে ট্রাক থেকে নামতে থাকে। কেউ-কেউ ট্রাক থেকে নেমেই দৌড় দেয় এবং অন্যরা গুলি ছোড়া শুরু করে। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালায়। অল্প সময়ের মধ্যে আরো কিছু পাকিস্তানি সেনা সেখানে এসে উপস্থিত হয়। মনির আহমেদ খান ও তাঁর গ্রুপের সহযোদ্ধারা বেশ খানিকটা এগিয়ে ধর্মনগর-হরষপুর-পাইকপাড়া হয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে তাঁরা দ্রুত পিছিয়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। পাকবাহিনীও মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্লাটুন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পাশেই তিতাস নদীর অপর পারে চলে যায়, আরেকটি প্লাটুন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। মনির আহমেদ খান তাঁর গ্রুপ নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর আক্রমণে পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে যায়, রক্ষা পান অধিনায়ক কে এম সফিউল্লাহ। এ-যুদ্ধে দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ক্যাপ্টেন এ এস এম নাসিমসহ ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। অপরদিকে ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার সুবেদার মনির হোসেন খানকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে। তিনি ১৯৮০ সালে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম বেনু আরা বেগম। এ দম্পতি ১ পুত্র সন্তানের জনক-জননী। বীর মুক্তিযোদ্ধা মনির আহমেদ খান ২০১২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। [শফিউদ্দিন তালুকদার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড