মধ্যম নাথপাড়া গণহত্যা (চট্টগ্রাম)
মধ্যম নাথপাড়া গণহত্যা (চট্টগ্রাম) সংঘটিত হয় ৩১শে মার্চ চট্টগ্রামের দক্ষিণ কাট্টলীতে। এটি ছিল হিন্দুপ্রধান একটি পাড়া। সেদিন এখানে তিন শতাধিক নিরীহ লোক পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পাকবাহিনীর সহযোগিতায় বিহারিরা প্রধানত তলোয়ার দিয়ে পৈশাচিকভাবে তাদের হত্যা করে।
২৬শে মার্চ চট্টগ্রামের হালিশহর ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) ক্যাম্প এবং পার্শ্ববর্তী সমগ্র এলাকা বাঙালি সৈন্যরা দখল করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু ৩০শে মার্চ পাকবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁদের সে দখল ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। এদিন দুপুরের পর পাকিস্তানি সেনা ও নৌবাহিনী ইপিআর ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেক বাঙালি ইপিআর সদস্য মধ্যম নাথপাড়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
পাকিস্তানি সৈন্যরা ইপিআর ক্যাম্প দখল করার পর হালিশহরের বিভিন্ন ব্লকের বিহারিরা মাইকিং করে পাকিস্তানিদের স্বাগত জানায়। তারা বিহারি নেতা শওকতের নেতৃত্বে বিভিন্ন ব্লকে পাকিস্তানি পতাকা ওড়ায় ও মিছিল করে। এক পর্যায়ে তারা বিহারি ব্লকগুলোর পার্শ্ববর্তী হিন্দু অধ্যুষিত মধ্যম নাথপাড়া ঘেরাও করে। এ পাড়ায় অনেক প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মী বসবাস ছিল স্বাধীনতার পক্ষের একটি শক্ত ঘাঁটি। ১৯৭০-এর নির্বাচনে এখানকার মানুষ বিহারিদের বিপক্ষে নৌকা প্রতীকের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখে। তাই বিহারিরা তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। সেই ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বিহারিরা ৩১শে মার্চ পাকবাহিনীকে নিয়ে নাথপাড়ায় আক্রমণ চালায়।
পাকসেনাদের একটি বড় দল নাথপাড়ায় প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়ে ত্রাসের সৃষ্টি করে। বিহারিরা পাড়া ঘেরাও করার পর পাড়ার বাসিন্দারা যুগল কৃষ্ণ নাথ মহাজনের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বিপদে সবাই এক সঙ্গে থাকবে এই ছিল তাদের প্রতিজ্ঞা। অনেকে পাড়ার হরিপদ বাবুদের মন্দিরেও আশ্রয় নেয়। পাকসেনারা নাথপাড়ায় ঢুকে প্রথমে এখানে আশ্রয় নেয়া শতাধিক ইপিআর সদস্যকে হত্যা করে। তারপর তারা বিহারিদের সঙ্গে মিলে স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর আক্রমণ চালায়। শুরু হয় নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এখানে তারা বুলেটের পরিবর্তে ধারালো তলোয়ার ব্যবহার করে। তলোয়ার দিয়ে কাউকে জবাই করে, কারো পেট চিরে, কারো দেহের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে হত্যা করে। কাউকে আবার বস্তায় পুরে হত্যা করে। বিহারিরা এভাবে একের পর এক সাধারণ ভয়ার্ত মানুষদের হত্যা করে, আর পাকসেনারা তাদের পাহারা দেয়। হত্যা করার সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ও মুজিবের নাম উচ্চারণ করে বাঙালিদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। রাজনৈতিক কর্মী দীনেশ কান্তি নাথকে তারা ছয় টুকরো করে, কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা প্রচার করতেন। একইভাবে দুই সহোদর বাদল কান্তি নাথ ও দুলাল কান্তি নাথ (পিতা হরিরঞ্জন নাথ)-কে হত্যা করে। বাদল কান্তি নাথ ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শেষবর্ষ সম্মানের ছাত্র এবং তিনি ছাত্রলীগ- করতেন। দুলাল কান্তি নাথ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন-কর্মী।
সেদিন প্রচণ্ড জিঘাংসা ও অমানবিক উন্মত্ততা নিয়ে হানাদাররা এ হত্যাকাণ্ড চালায়। নারী-পুরুষ, কোলের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউ রক্ষা পায়নি ৷ বিকাশ কান্তি নাথ নামে একই পাড়ার এক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষাৎকার দানকালে সেদিনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন এভাবে: ‘ছয় দফাপন্থী দীনেশ কান্তি নাথ (২৫)-কে হত্যা করে ৬ টুকরো করে। সমীরণ চন্দ্র নাথকে হত্যা করে বর্শা দিয়ে। সুনীল চন্দ্র নাথ মনু (১৭)-কে হত্যা করে জীবিত অবস্থায় গায়ের চামড়া তুলে। বনমালী নাথের মেয়ে নিনু রাণী (৮)-কে হত্যা করে মায়ের কোল থেকে নিয়ে নরহরি বৈষ্ণবকে হত্যা করে টোটা দিয়ে। গণেশ চন্দ্র সাহা (৪০) ও হেমেন্দ্র লাল সাহাকে হত্যা করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে। ডা. বাদল কান্তি নাথের বড়ভাই নারায়ণ চন্দ্র নাথকে হত্যা করে তেলের ড্রামের ভেতরে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে। অনিল বিহারী নাথকে হত্যা করে পুকুরে গুলি করে।’ এসব হত্যাকাণ্ডের পর তারা সমগ্র পাড়ায় লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে।
এদিন নিহতদের মধ্যে স্থানীয় কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন— হরিরঞ্জন নাথ, ক্ষীরোদ চন্দ্ৰ নাথ, পূর্ণ চন্দ্ৰ নাথ, দুলাল কান্তি নাথ, বাদল কান্তি নাথ, অনিল বিহারী নাথ, ব্রজেন্দ্র লাল সাহা, গণেশ চন্দ্র সাহা, শ্রীদাম চন্দ্ৰ নাথ, অবর্ন চরণ নাথ, শান্তিপদ নাথ, গৌর চন্দ্র মহাজন, হেমেন্দ্ৰ মহাজন, মানিক চন্দ্ৰ নাথ, সমীরণ চন্দ্র নাথ, প্ৰকাশ চন্দ্ৰ নাথ, সুনীল কান্তি নাথ (মনু), অক্ষয় কুমার নাথ, নারায়ণ চন্দ্র নাথ, লক্ষ্মণ চক্রবর্তী, ধীরেন্দ্র লাল নাথ (কবিরাজ), নারায়ণ চন্দ্র নাথ, হরিমোহন বৈষ্ণব, বাসুদেব বৈষ্ণব, নরহরি বৈষ্ণব, ননী গোপাল নাথ, বনমালী নাথ, সুধাংশু বিমল নাথ, শিউলি রাণী (মিনু), সুবল চন্দ্র নাথ, তপন চন্দ্র নাথ, শশী কুমার নাথ, নিশিকান্ত নাথ, দীনেশ চন্দ্র নাথ, ক্ষেত্র মোহন নাথ, রমণী মোহন নাথ, গোবিন্দ চন্দ্ৰ নাথ প্রমুখ। প্রথম পাঁচজন একই পরিবারের। এমনও আছে যে, একই পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে।
নাথপাড়ার শহীদদের স্মরণে ২০০১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। এর জন্য জমি দান করেন বিমল কান্তি নাথ, শ্যামল কান্তি নাথ ও নির্মল কান্তি নাথ। স্থপতি ছিলেন ঢালী আল মামুন। [সাখাওয়াত হোসেন মজনু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড