মনতলা যুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ)
মনতলা যুদ্ধ (মাধবপুর, হবিগঞ্জ) সংঘটিত হয় ২১শে জুন। এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। এদিন পাকহানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটির ওপর গোলন্দাজ বাহিনী ও হেলিকপ্টার নিয়ে সর্বাত্মক আক্রতণ চালায়। ফলে মনতলা ঘাঁটির পতন ঘটে। তবে মুক্তিযোদ্ধারা ভারত সীমান্তের অভ্যন্তরে সরে যেতে সক্ষম হন।
আখাউড়া-সিলেট রেল সেকশনের মাধবপুর উপজেলার অধীন একটি স্টেশনের নাম মনতলা। এটি সীমান্তবর্তী একটি অঞ্চল। মনতলা স্টেশন আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে ৫ কিমি পশ্চিমে, তেলিয়াপাড়া রেলস্টেশন থেকে ৭ কিমি দক্ষিণে এবং হরষপুর রেল স্টেশন থেকে ৮ কিমি উত্তরে অবস্থিত। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পূর্বদিকে মনতলা, কাশিমনগর ও হরষপুর রেল স্টেশন এলাকা নিয়ে মনতলা যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থান।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে মনতলা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। আশুগঞ্জ ও মাধবপুরের পতনের পর মেজর কে এম সফিউল্লাহ্র নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তেলিয়াপাড়া-মনতলা-হরষপুর অঞ্চলে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করে। ২০শে মে তেলিয়াপাড়া পতনের পর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের সৈন্যরা মনতলা, হরষপুর ও সিংগারবিল এলাকায় তাদের অবস্থান সংহত করে। ফলে আখাউড়া-সিলেট রেলপথ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে। পাশাপাশি ঢাকা-সিলেট সড়কপথ মনতলার কিছুটা কাছাকাছি হওয়ায় উক্ত সড়কপথেও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে খানিকটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুযোগ ছিল। এ এলাকাটি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সর্বশেষ অংশ হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এর গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। তাই তারা এ ভূখণ্ডটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তেলিয়াপাড়া হাতছাড়া হওয়ার পর তাদের একমাত্র আশা-ভরসা মনতলার ওপর নিবদ্ধ ছিল। এখানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের দু-কোম্পানি সৈন্য মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার পর মনতলা রক্ষার কাজে মাত্র তিনটি কোম্পানি নিয়োজিত ছিল।
আখাউড়া-সিলেট রেলপথ উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। এ পথের ওপরেই মনতলা। সেক্টর কমান্ডার তাঁর তিনটি কোম্পানিকে এখানে মোতায়েন করেন। ক্যাপ্টেন নাসিমের কোম্পানির দখলে রয়েছে মনতলা এলাকা এবং রেল স্টেশন। তার দক্ষিণে রয়েছে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার কোম্পানি। তিনি কাশিমনগর রেল স্টেশন এবং তৎসংলগ্ন এলাকা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। লে. মোরশেদকে তৃতীয় কোম্পানির নেতৃত্ব দেয়া হয়। তার কোম্পানি হরষপুর এলাকা ও রেল স্টেশনে অবস্থান নেয়। এ তিনটি কোম্পানি পাকিস্তানিদের সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত ক্ষতিসাধন করে।
তেলিয়াপাড়া থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে দেয়ার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের মাটি থেকে তাঁদের সম্পূর্ণ বিতাড়িত করার জন্য সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে। তিন সপ্তাহ ধরে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান লক্ষ করে বিক্ষিপ্ত আক্রমণ চালাতে থাকে। কিন্তু সে আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতাড়িত করা সম্ভব হয়নি। বরং প্রচলিত পদ্ধতির রণকৌশল তাদের জন্য বড়ো রকমের ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। প্রচলিত পদ্ধতিতে কিছু করতে ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানিরা তাদের কৌশলগত পরিবর্তন করে বেপরোয়া আক্রমণ অব্যাহত রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু তাঁদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিয়োজিত, সেহেতু তাঁরাও মরিয়া হয়ে ওঠেন। তাঁরা আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে পাক বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন। ১৫ই জুনের পর থেকে পাকসেনাদের রণকৌশলে পরিবর্তন হয়। দেখা যায়, মনতলা রেল স্টেশনের দিকে পরিখা খননের মাধ্যমে তারা এগিয়ে আসছে। একটি ব্যাটালিয়ন আসে উত্তর দিকের ইটাখোলা থেকে, আরেকটি আসে পশ্চিম দিক থেকে।
দিনের বেলা পাকিস্তানিরা পরিখা থেকে ক্ষুদ্র অস্ত্র ব্যবহার করে এবং ইটাখোলা ও মাধবপুর থেকে গোলন্দাজ বাহিনী কর্তৃক গোলাবর্ষণের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। রাতের বেলা আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায়। শুরু হয় ভয়াবহ গোলাবর্ষণ, যা বৃষ্টির মতো মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানসমূহে বর্ষিত হতে থাকে। যুগপৎভাবে পদাতিক বাহিনী রাতের অন্ধকারের সুযোগে পরিখা তৈরির কাজ চালিয়ে যায় এবং হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়। মাঝে-মাঝে মর্টার ফায়ারে শত্রুদের অগ্রগতি থামিয়ে দেয়া সম্ভব হলেও তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর কামানগুলো মুক্তিবাহিনীর মর্টারগুলোর লক্ষ্যসীমার বাইরে থাকায় এগুলো তেমন কাজে আসেনি। তাছাড়া পাকসেনাদের আধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাধারণ অস্ত্র তাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারায় শত্রুরা নিরাপদই থেকে যায়। পরিস্থিতি অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধাদের যে শক্তিমাত্রায় আক্রমণ করা দরকার তার সুযোগ ছিল না। পাঁচদিন ধরে এ অবস্থা চলে। একের পর এক পরিখা খনন করে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি ব্যাটালিয়নগুলো ২০শে জুনের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর কাছাকাছি চলে আসে। ইতোমধ্যে যুদ্ধের সকল ফ্রন্টে তাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তারা আকাশ থেকে বিমানযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী আক্রমণ চালাতে থাকে।
পরদিন ২১শে জুন সকালে পাকিস্তান বাহিনী মনতলা ব্যূহে বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। তারা সেখানে ৪টি ব্যাটালিয়নের সমাবেশ ঘটায়। তখন উভয় পক্ষে সৈন্য সমাবেশের অনুপাত ছিল প্রতি ৪ জন শত্রুসেনার বিপরীতে মাত্র ১ জন মুক্তিযোদ্ধা। পাকসেনারা তিন দিক থেকে একযোগে আক্রমণ করে। পেছন থেকে চালানো হয় গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ। আর হেলিকপ্টারে স্থাপিত পর্যবেক্ষণ যন্ত্র সঠিক লক্ষ্যস্থলে আঘাত হানার ব্যাপারে শত্রুবাহিনীকে তথ্য পরিবেশন করতে থাকে।
ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থানে পরিখার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া দুটি ব্যাটালিয়ন আক্রমণ চালায়। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার অবস্থানে পশ্চিম দিকের চান্দুরা থেকে একটি ব্যাটালিয়ন আক্রমণ চালায়। লে. মোরশেদের অবস্থানে অভিযান চালায় দক্ষিণ-পশ্চিমের মুকুন্দপুর থেকে একটি ব্যাটালিয়ন। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়াকে আক্রমণকারী ব্যাটালিয়ন চান্দুরার দিক থেকে বিদুৎগতিতে তার অবস্থানকে বিধ্বস্ত করে দেয়। অতঃপর হরষপুরের দিকে মোড় ফিরে লে. মোরশেদের অবস্থান ঘিরে ফেলে।
এই অসম যুদ্ধের এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়ার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। পাকিস্তান বাহিনী হেলিকপ্টারে লে. হেলাল মোরশেদের কোম্পানির পেছনে কমান্ডো নামিয়ে দেয়ায় তার বাহিনী প্রায় অবরুদ্ধ ও বিপন্ন হয়ে পড়ে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। ক্যাপ্টেন নাসিম এক বেপরোয়া যুদ্ধে লিপ্ত। এক পর্যায়ে তিনিও মারাত্মক বেকায়দায় পড়ে যান। তিনি তাঁর শক্তি বৃদ্ধির জন্য আরো সৈন্য চেয়ে পাঠান। কিন্তু তখন সেক্টর কমান্ডারের কাছে রিজার্ভ কোনো নিয়মিত সৈনিক ছিল না। এ সময়ে শুধু ক্যাপ্টেন মতিনের বাহিনী কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। তাই সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানি থেকে এক প্লাটুন সৈন্য প্রেরণ করেন। লে. মোরশেদ শত্রুবেষ্টনী ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার প্রাণপণ লড়াইয়ে নিয়োজিত। কে এম সফিউল্লাহ ক্যাপ্টেন নাসিমকে নির্দেশ দেন ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে অভ্যন্তরে সরে যাবার জন্য। তিনি লে. মোরশেদকে বিপদমুক্ত করার জন্য ক্যাপ্টেন মতিনের মাত্র দুটি প্লাটুন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করেন। এ আক্রমণ ফলপ্রসূ হয়। শত্রুসেনারা কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে লে. মোরশেদের সৈন্যরা উদ্ধার হন। এ-যুদ্ধে দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা –দৌলা মিয়া- বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। [মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড