বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান
মতিউর রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৪১-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৪১ সালের ২৯শে অক্টোবর ঢাকার আগা সাদেক রোডের বাড়িতে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম আব্দুস সামাদ এবং মাতার নাম মোবারকুন্নেসা। এ দম্পতির ১১ সন্তানের মধ্যে মতিউর রহমানের অবস্থান ছিল ৮ম। মতিউর রহমানের পিতা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। তাঁদের পূর্ব- পুরুষের আদিনিবাস ছিল ভৈরব উপজেলায়। তাঁর দাদা বর্তমান নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার অন্তর্গত রামনগর (বর্তমান মতিউর নগর) গ্রামে বসতি
স্থাপন করেন। তাঁর এক ভাইয়ের নাম খোরশেদ আলম। চাকরি জীবনে তিনি পাকিস্তানের সিএসপি কর্মকর্তা, স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থসচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। মতিউর রহমানের স্ত্রীর নাম মিলি রহমান। ১৯৬৮ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁরা দুই কন্যা সন্তানের জনক-জননী। মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে বিমান নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসার পথে মতিউর রহমান দুর্ঘটনায় শহীদ হন।
শৈশব থেকে মতিউর রহমান ছিলেন একরোখা স্বভাবের। খেলাধুলার প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড আকর্ষণ। ১৯৫২ সালে ১১ বছর বয়সে তাঁকে সদরঘাটে অবস্থিত ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এর পূর্বে তাঁর লেখাপড়া চলে বাড়িতে বড়দের তত্ত্বাবধানে। স্কুল জীবন থেকেই মতিউর রহমান মেধার স্বাক্ষর রেখে আসেন। তাঁর জীবনের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে বিমান বাহিনীতে যোগদান ও যুদ্ধ বিমানের পাইলট হওয়া। ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোদায় অবস্থিত পাকিস্তান বিমান বাহিনী স্কুলে ভর্তির প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং তাতে সফলকাম হন। এ স্কুলে অধ্যয়নকালে একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি স্কাউটিং- এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এক পর্যায়ে স্কুলের সিনিয়র ছাত্র হিসেবে তিনি গ্লাইডার প্রশিক্ষণ নেন এবং তাতে বিশেষ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেন। ১৯৬০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সকল নির্বাচনী পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে একই বছর ১৫ই আগস্ট তিনি ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেবে রিসালপুর পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমিতে যোগ দেন। শীঘ্রই একজন বুদ্ধিদীপ্ত ও চৌকস ক্যাডেট হিসেবে তিনি প্রশংসিত হন। দুবছর সাফল্যর সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৩ সালে তিনি পাইলট হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ফ্লাইং অফিসার হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন এবং তাঁকে পেশোয়ারে ফাইটার স্কোয়াড্রনে নিয়োগ দেয়া হয়। সেখানে তিনি জঙ্গি বিমানের পাইলট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর তিনি সফলভাবে ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর প্রশিক্ষণ সমাপ্তি শেষে রিসালপুর বিমান বাহিনী একাডেমিতে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে যোগ দেন এবং প্রশিক্ষক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন।
মতিউর রহমান ছিলেন মনে-প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি, একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি ও দেশাত্মবোধক গান ছিল তাঁর প্রিয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে চাকরির কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করতে হলেও উর্দু ভাষা, ভাতের বদলে রুটি এসবে ছিল তাঁর প্রচণ্ড অপছন্দ। পশ্চিম পাকিস্তানে বসেও তিনি সস্ত্রীক সিনেমা হলে বাংলায় নির্মিত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা’ চলচ্চিত্র ও জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেওয়া’ চলচ্চিত্র দেখতে যান এবং দেখে মুগ্ধ হন। চাকরিকালে তিনি দেখেছেন কীভাবে বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বৈষম্য ও বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ করে। এরূপ একটি ঘটনা এখানে উল্লেখযোগ্য। এক পাঞ্জাবি সহকর্মী একদিন তাঁকে আকাশ যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি ঐ চ্যালেঞ্জ সানন্দে গ্রহণ করেন। বিমান নিয়ে উভয়ে আকাশে উড্ডীন অবস্থায় হঠাৎ মতিউরের বিমানের ইঞ্জিনে অপর বিমান থেকে ছোড়া গুলি লেগে আগুন ধরে যায়। তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেও বিমানটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ ঘটনায় উভয়ের কোর্ট মার্শাল হয়। বিচারে এক বছরের জন্য মতিউরের বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা হয়, অপরদিকে পাঞ্জাবি পাইলটের কোনো শাস্তিই হয়নি। এ ঘটনা মতিউরের মনে গভীর রেখাপাত করে। পশ্চিম পাকিস্তানে থাকলেও পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের তখনকার গণআন্দোলন সম্বন্ধে মতিউর রহমান সবসময় খোঁজখবর রাখতেন এবং অন্যান্য বাঙালিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রতি 3 ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। ১৯৭০ সালের শেষদিকে এক মাসের ছুটি নিয়ে মতিউর রহমান ঢাকায় আসেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭০-এর নির্বাচনোত্তর বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম দ্রুত চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। মতিউরের এক মাসের ছুটি শেষ। কিন্তু তিনি পাকিস্তানে চাকরিতে ফিরে না গিয়ে ঢাকায় গণ-আন্দোলন ও মিছিলে যোগ দিতে থাকেন। ৭১-এর ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনে যান। বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ তিনি সেখানে উপস্থিত থেকে শোনেন এবং ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ হন। এরপর তিনি সরাসরি নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে চলে যান এবং ছাত্র-যুবক ও স্থানীয়দের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণদান শুরু করেন। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা তাঁকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ ও পীড়িত করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ভারতে গিয়ে যুদ্ধে যোগদানের প্রচেষ্টা নেন, কিন্তু তা সফল হয়নি। এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে জনগণসহ বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর প্রমুখের সর্বাত্মক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যুদ্ধ বিমান নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করে। এর মোকাবেলায় একজন পাইলট হিসেবে মতিউর রহমান প্রতিরোধ যুদ্ধে যুদ্ধ বিমানের আবশ্যকতা চরমভাবে অনুভব করেন। এ চিন্তা মাথায় রেখে ৯ই মে তিনি সপরিবারে পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান এবং চাকরিতে যোগদান করেন। পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তারা কিছুতেই বাঙালিদের বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাই বাঙালি পাইলটদের উড্ডয়ন থেকে বিরত রেখে গুরুত্বহীন কাজে নিয়োজিত করা হয়। এদিকে মতিউর একের পর এক সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কৌশলে একটি পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান হস্তগত করে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তিনি মনে-মনে পরিকল্পনা করেন। তাঁর মনের এ গোপন কথা তিনি তাঁর স্ত্রী ও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বাঙালি পাইলটদের বলেন। অবশেষে ২০শে আগস্ট এলো সেই প্রতিক্ষীত দিন। করাচির নিকটস্থ মাশরুর বিমান ঘাঁটি থেকে রশীদ মিনহাজ নামে মতিউরের এক সময়কার পাকিস্তানি বৈমানিক ছাত্র রুটিন ফ্লাইং-এর অংশ হিসেবে একটি বিমান নিয়ে উড্ডয়নের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মতিউর হঠাৎ করে ঐ বিমানে উঠে মিনহাজের নাকে ক্লোরোফর্ম ভেজানো রুমাল চেপে ধরেন এবং তাকে সরিয়ে ককপিটে বসে পড়েন। মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারে বিমান হাইজ্যাকের মেসেজ দিয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে দুটি পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান মতিউরের বিমানটিকে ট্র্যাক করতে আকাশে উড্ডয়ন করে। পাকিস্তানি রাডারকে ফাঁকি দিয়ে মতিউর গন্তব্যে পৌঁছতে খুব দ্রুত গতিতে নিচ দিয়ে বিমান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এভাবে ১২ মিনিট অগ্রসর হওয়ার পর যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়ায় বর্ডারের কাছাকাছি স্থানে বিমানটি বিধ্বস্থ হয় এবং রশীদ মিনহাজসহ মতিউরের মর্মমান্তিক মৃত্যু ঘটে। ঐদিন রাতেই মাশরুর বেইসের কবরস্থানে মতিউরের লাশ দাফন করা হয়। স্বাধীনতার ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালে ঐ কবরস্থান থেকে মতিউরের দেহাবশেষ এনে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
শহীদ মতিউরের এই দুঃসাহসী অভিযান তখন বিবিসি-, আকাশবাণী সহ বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে গুরুত্বসহকারে স্থান পায়। তাঁর দেশপ্রেম ও জীবনকে বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে তাঁর এ প্রচেষ্টা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। স্বাধীনতার জন্য এভাবে জীবন উৎসর্গ করে মতিউর যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, এর স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর স্মরণে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার রামনগরের নাম মতিউর নগর এবং সেখানে একটি গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড