You dont have javascript enabled! Please enable it!

মদন থানা যুদ্ধ (মদন, নেত্রকোনা)

মদন থানা যুদ্ধ (মদন, নেত্রকোনা) সংঘটিত হয় দুবার ২৮ ও ২৯শে আগস্ট এবং ১লা নভেম্বর। মদন থানা সদরে দখল প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে এ-যুদ্ধ হয়।
২৮শে আগস্ট মদনের যুদ্ধ ছিল সমগ্র নেত্রকোনা জেলার মধ্যে একটি ভয়াবহ যুদ্ধ। সে-সময় মদন থানা সদর মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। কাজী সামছুল আলম কোম্পানির ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা মদন দখলে রেখে সমগ্র ভাটি অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। পরে সে কোম্পানির সঙ্গে মাহবুব আলম কোম্পানি যুক্ত হয়। মাহবুব কোম্পানির যোদ্ধা ছিলেন ২৫-২৬ জন। পাকিস্তানি হানাদাররা কেন্দুয়া হয়ে গুগবাজার-কাইটাল পথে মদনের দিকে এগিয়ে আসছিল। কাইটাল হয়ে বাহেরাখলা নদী অতিক্রম করার সময় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের খবর পান। তারা ২৮শে আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে মদনের জাহাঙ্গীরপুর হাইস্কুল মাঠে অবস্থান নেয়। জাহাঙ্গীরপুর ও মদন থানা সদরের মাঝখানে মগড়া নদী। মুক্তিযোদ্ধারা এ নদীতে ওঁৎ পেতে থাকেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা নৌকায় মগড়া নদী পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে। তাদের নৌকা নদীর মাঝখানে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এলএমজি-র ব্রাশ ফায়ারে নৌকাটি ঝাঁঝরা হয়ে যায়। নৌকায় থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা পানিতে তলিয়ে যায়। ভরা বর্ষা মৌসুমে খরাস্রোতা মগড়া সাঁতরিয়ে কয়েক জন জাহাঙ্গীরপুরের তীরে উঠতে সক্ষম হয়। সে-সময় ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরপুর হাইস্কুল মাঠে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের কয়েকশ গজ দূরে অবস্থান নেন। নদী থেকে ফিরে আসা পাকিস্তানি বাহিনী জাহাঙ্গীরপুর হাইস্কুল মাঠে অবস্থানরতদের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার পরই মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ জনের দল দ্বিতীয় আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদারদের বেশ কয়েকজন নিহত হয়। পরে ৫ সদস্যের আক্রমণকারী মুক্তিযোদ্ধা দল নদী পার হয়ে মদন থানা সদরে তাঁদের কোম্পানির সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়। এরপর মগড়া নদীর দুতীর থেকে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সারারাত যুদ্ধ চলে।
পরদিন ২৯শে আগস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সকাল ৮টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মগড়া নদী পাড়ি দিয়ে মদন থানা সদরে প্রবেশের চেষ্টা করে। তারা নৌকায় মলীয়াপাড়া দিয়ে নদী পাড়ি দেয়ার সময় নদীর মাঝপথে আসতেই মুক্তিযোদ্ধারা আবার আক্রমণ করেন। এলএমজি-র ফায়ারে নৌকা পানিতে তলিয়ে যায়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর একজন মেজরসহ অনেকে নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করে আবার জাহাঙ্গীরপুর হাইস্কুল মাঠে গিয়ে জড়ো হয়।
হানাদারদের প্রাণহানি, পরাজয় ও বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়ে তাদের সাহায্য করতে দুপুর ১টার পর মদনের আকাশে একটি হেলিকপ্টার উড়ে আসে। হেলিকপ্টার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর দুই ইঞ্চি মর্টার ও মেশিনগানের গুলি ছোড়া হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী (করিমগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ), আব্দুল জাহেদ (মদন) এবং প্লাটুন কমান্ডার আব্দুল কুদ্দুছ আহত হন। রকেট শেলবিদ্ধ আব্দুল কুদ্দুছকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গোবিন্দশ্রী গ্রামে সরিয়ে নেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ ছাড়া উপায় ছিল না। অত্যধিক রক্তক্ষরণের কারণে আব্দুল কুদ্দুছ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বাড়ি মদন থানার হাঁসকুড়িতে হলেও তাঁকে গোবিন্দশ্রী গ্রামে সমাহিত করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করায় পাকবাহিনী সাময়িকভাবে মদনের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা করে। মদনের এ যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে। মিরাশী নামের একজন নারী যুদ্ধক্ষেত্রে হামাগুড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করেন। এ-যুদ্ধে ১৫৫ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৫০-৬০ জন রাজাকার নিহত হয়।
১লা নভেম্বর কাজী সামছুল আলম কোম্পানির ২৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ৪ ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোর ৪টা থেকে মদনে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করেন। পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ করলে দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। এ-যুদ্ধ ১৪৮ ঘণ্টা ধরে চলে। বিরতিহীন এ-যুদ্ধ ছিল নেত্রকোনা রণাঙ্গনের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। তাদের উদ্ধারে নেত্রকোনা থেকে ৫ শতাধিক সৈন্যের একটি বড় দল অগ্রসর হলে তারা কাইটাল নামক গ্রামে নজরুল কোম্পানি ও মাহবুব কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে পড়ে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিরা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে-করতে মদনের দিকে অগ্রসর হয়। এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীরপুর হাইস্কুল মাঠে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান নেয়। সেখান থেকে মদন থানা সদরে আটকেপড়া পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। সদরে অবরুদ্ধ পাকিস্তানি সেনারা নদী পাড়ি দিয়ে জাহাঙ্গীরপুর হাইস্কুল মাঠে অবস্থানরত দলটির সঙ্গে মিলিত হয়। সেখান থেকে ৬ই নভেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের উভয় দল মদন ত্যাগ করে নেত্রকোনা সদরে চলে যায়। এদিন মদন সদরে ৪৫ জন পাকিস্তানি সেনার লাশ পড়ে ছিল। [মোহাম্মদ খায়রুল হক]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!