বীর প্রতীক মঞ্জুর আহমেদ
মঞ্জুর আহমেদ, বীর প্রতীক (জন্ম ১৯৫২) মেজর ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৫২ সালের ১৩ই এপ্রিল ঢাকার সুত্রাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুস সুলতান মল্লিক এবং মাতার নাম মনিরুন নেছা খানম। কলকাতার ডন বসকো স্কুলে তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। তিনি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের মারী হিলস্-এ অবস্থিত পাকিস্তান এয়ারফোর্স পাবলিক স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের সারাগোদার পাকিস্তান এয়ারফোর্স কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। অতঃপর তিনি পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ৫৬ জিডিপি-র আইএসএসবিতে উত্তীর্ণ হলেও মেডিকেল বোর্ড থেকে তাঁকে চাকরিতে যোগদানে বিলম্বিত করা হয়। এমতাবস্থায় ৭১-এর ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে তার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ- তাঁকে উদ্দীপ্ত করে। এমনি প্রেক্ষাপটে দেশমাতৃকার টানে মঞ্জুর আহমেদ পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন এবং এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা থেকে দার্জিলিং- শিলিগুড়ি-গৌহাটি হয়ে আগরতলার মতিনগর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। সেখানে ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের নেতৃত্বে অন্যান্যদের সঙ্গে তিনি বিস্ফোরক ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নেন।
মে মাসের শেষদিকে মঞ্জুর আহমেদসহ ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা মুহুরী নদীর ওপর নির্মিত রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। এতে নেতৃত্ব দেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আহমদ মুনীর ভাষণ। তাঁদের প্রটেকশন দেন ১৭ জন ইপিআর মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম অপারেশনে তাঁরা সফল হন। অতঃপর মঞ্জুর আহমেদ ভারতের পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি জেলায় অবস্থিত মূর্তি ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রথম বাংলাদেশ ওয়্যার ফোর্সের ১৫ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ শেষে ৯ই অক্টোবর কমিশনপ্রাপ্ত হন। তাঁর সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালও প্রশিক্ষণ নেন এবং তিনিও কমিশন লাভ করেন। ট্রেনিং শেষে মঞ্জুর আহমেদ তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর শাফায়াত জামিলের অধীনে আলফা কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আনোয়ারের একজন প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে যোগ দেন। ছাতক যুদ্ধে ক্যাপ্টেন আনোয়ার পাকবাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে গেলে মঞ্জুর আহমেদ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ২৫শে অক্টোবর সংঘটিত সিলেটের গোয়াইনঘাট যুদ্ধ ছিল তাঁর নেতৃত্বে প্রথম যুদ্ধ। এ-যুদ্ধে চরম বিপর্যয়ের মুখে তিনি অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পাকবাহিনীর মোকাবেলা করার চেষ্টা করেন। এখানে ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৩০ জন আহত হন। বেশ কয়েকজন পাকসেনাও হতাহত হয়।
২৬শে নভেম্বর মিত্রবাহিনী-র সাউথ ওয়েস্টার্ন ফোর্স কমান্ডার কর্নেল রাজ সিং-এর নেতৃত্বে গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা রাধানগর আক্রমণকালে মঞ্জুর আহমেদ রাধানগরের পশ্চিম পাশে অবস্থিত কাফাউড়া গ্রামে এফইউপি স্থাপন করে গ্রাউন্ড ফায়ার সাপোর্ট দেন এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিপর্যস্ত গুর্খাদের পজিশন থেকে প্রত্যাহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৯ ও ৩০শে নভেম্বর ডেলটা কোম্পানি ও এফএফ বাহিনী ছোটখেল ও রাধানগর দখল করে।
৪ঠা ডিসেম্বর মঞ্জুর আহমেদ ও লেফটেন্যান্ট ইয়ামিনের নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার গোয়াইনঘাটে অভিযান চালানো হয়। এ অভিযানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকবাহিনী পিছু হটলে গোয়াইনঘাট মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ১৭ই ডিসেম্বর তিনি সিলেট শহরে প্রবেশ করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অসাধারণ রণনৈপুণ্য অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশ সরকার মঞ্জুর আহমেদকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে তিনি ‘মেজর’ পদে উন্নীত হন। তিনি ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম গুলশান মঞ্জুর। পারিবারিক জীবনে তিনি ২ পুত্র সন্তানের জনক। [শফিউদ্দিন তালুকদার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড