You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মঠবাড়িয়া উপজেলা (পিরোজপুর)

মঠবাড়িয়া উপজেলা (পিরোজপুর) বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৫৮ কিলোমিটার উত্তরে বলেশ্বর নদের তীরে অবস্থিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- প্রার্থী সওগাতুল আলম সগির এ অঞ্চল থেকে এমপিএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বাঙালিদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নিকট ক্ষমতা না দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ষড়যন্ত্র শুরু করে। এর ফলে বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে পরদিন ছাত্রলীগ-এর উদ্যোগে মঠবাড়িয়ায় প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। এদিন মঠবাড়িয়া থানা ছাত্রলীগের নেতা এমাদুল হক খানকে আহ্বায়ক করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর স্থানীয় শাখা গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছাত্রনেতা মোস্তফা শাহ আলম দুলাল (সোনাখালী) ও রোস্তম আলী ফরাজী (সোনাখালী), ছাত্রলীগের সাদিকুর রহমান শিকদার (মিঠাখালী), আব্দুল মোতালেব ফারুকী (মিঠাখালী), দেলোয়ার হোসেন (টিকিকাটা), আব্দুল হালিম জমাদ্দার (মিঠাখালী), শাহজাহান আলী (ঘটিচোরা), মোশারেফ হোসেন নানু (বেতমোড়), ছাত্র ইউনিয়ন-এর কিসলু মিয়া (দাউদখালী), ফারুকউজ্জামান (দাউদখালী) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ পরদিন রেডিওতে শোনার পর সারা দেশের মতো মঠবাড়িয়ার জনগণও বুঝতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধ আসন্ন। তাই আওয়ামী লীগ, ন্যাপ-, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা- কর্মী ও মুক্তিকামী জনতা সওগাতুল আলম সগির এমপিএ-র নেতৃত্বে সংগঠিত হতে শুরু করে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।
১২ই মার্চ থেকে মঠবাড়িয়ার গুলিসাখালী জি কে ইউনিয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে হাবিলদার ফখরুদ্দিন (গুলিসাখালী), সুবেদার মেজর আব্দুল লতিফ (গুলিসাখালী), হাবিলদার আব্দুল লতিফ (বহেরাতলা), হাবিলদার মোতালেব মৃধা (বকসির ঘটিচোরা), হাবিবুর রহমান ওরফে গেরিলা হাবিব (পূর্ব সাপলেজা), আনসার কমান্ডার লালমিয়া হাওলাদার (গুলিসাখালী) প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এখানে প্রায় ২০০ ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়। মার্চ মাসের শেষদিকে তুষখালী ডাকবাংলোর সামনে সুবেদার সোহরাব, আজিজুর রহমান গোলদার ও সোয়েব গোলদার এবং সরোজিনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে হাবিলদার আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস (ফুলঝুড়ি), নায়েক মোতালেব শরিফ (ফুলঝুড়ি) প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এপ্রিল মাসের শুরুতে মঠবাড়িয়া সদরে কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশন খেলার মাঠ (বর্তমানে শহীদ মোস্তফা খেলার মাঠ)-এও প্রশিক্ষণ চলে। ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসের কর্মচারী গোপাল চন্দ্র শীলের মাধ্যমে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মতিউর রহমানের নিকট পৌঁছায়। এদিন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এক বিশাল মিছিল বের হয় এবং মিছিলশেষে শহরের বটতলায় আয়োজিত এক সমাবেশে মঠবাড়িয়াকে মুক্তাঞ্চল হিসেবে রক্ষা করা ও পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করা হয়। শপথবাক্য পাঠ করান ছাত্রনেতা মোস্তফা শাহ আলম দুলাল। এরপর ঢাকার জিঞ্জিরায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শুকনো খাবার পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
৪ঠা এপ্রিল সওগাতুল আলম সগির এমপিএ-কে আহ্বায়ক করে স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন— এম সামছুল হক এমএনএ, ডা. মতিউর রহমান, আব্দুল খালেক (থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক), শামসুল আলম মোক্তার (থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক), কর্পোরাল (অব.) আবুল বাশার মোহাম্মদ আব্দুস সামাদ (মিঠাখালী, আগরতলা মামলার আসামি), ডা. শামসুল আলম (গুলিসাখালী, থানা ন্যাপের সহ-সভাপতি), মোতাহার হোসেন চৌধুরী (টিকিকাটা), ছাত্র ইউনিয়নের বরিশাল জেলা কমিটির সভাপতি শহিদুল আলম বাদল (গুলিসাখালী), আদম আলী খান (আঙ্গুলকাটা), মুজিবুল হক খান মজনু, মোস্তফা শাহ আলম দুলাল, এমাদুল হক খান, আজিজুর রহমান গোলদার (তুষখালী) প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির সহযোগিতায় ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ৫ই এপ্রিল মঠবাড়িয়া পোস্ট অফিসে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। ৭ই এপ্রিল ৯ নং সেক্টরের সুন্দরবন অঞ্চলের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মঠবাড়িয়া থানা থেকে বেশ কয়েকটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল সংগ্রহ করে সেগুলো সওগাতুল আলম সগির এমপিএ-র নিকট হস্তান্তর করেন। মঠবাড়িয়ায় যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন পাঁচজন- মেজর মেহেদি আলী ইমাম, বীর বিক্রম (পিতা এম এন বিল্লাহ, দাউদখালী), হাবিলদার আনিছ মোল্লা, বীর বিক্রম (পিতা তছিল উদ্দিন মোল্লা, খয়ের ঘটিছড়া), ক্যাপ্টেন আলতাফ হোসেন (পিতা ডা. আবুল হাশেম আকন, বেতমোড়), মুজিবুল হক খান মজনু (পিতা ফকের উদ্দিন খান, ফুলঝুড়ি) এবং শহিদুল ইসলাম বাদল (পিতা রতন মিয়া, গুলিসাখালী)। মঠবাড়িয়ায় চারজন নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাঁরা হলেন- রোকেয়া হোসেন (স্বামী মুক্তিযোদ্ধা বেলায়েত হোসেন, 8 নম্বর ওয়ার্ড, মঠবাড়িয়া পৌরসভা), রোজিনা আনসারী (পিতা নূরুন নবী আনসারী, উপজেলা বাবুগঞ্জ), আয়শা পারভীন (স্বামী সুলতান হোসেন তালুকদার, বড় হারজী, মঠবাড়িয়া) এবং সালেহা বেগম (পিতা আবুল হাশেম আকন, বেতমোড়, মঠবাড়িয়া)। রোকেয়া হোসেন, রোজিনা আনসারী ও আয়শা পারভীন নবম সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব- সেক্টরে এবং সালেহা বেগম নবম সেক্টরের সুন্দরবন সাব- সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পুলিশ বাহিনীর হাবিলদার আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস ও নায়েক মোতালেব শরিফ ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফুলঝুড়িতে এসে সরোজিনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে ছাত্র-যুবকদের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করেন। ১৬ই মে মঠবাড়িয়া থানা শান্তি কমিটির সভাপতি আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার (পিতা ছাদেম আলী চৌকিদার, খেতাছিড়া; স্বাধীনতার পর আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার কৌশলে বিভিন্ন আশ্রয়ে দিন কাটায়। এইচ এম এরশাদের জাতীয় পার্টির মনোনয়নে একবার সে পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর সে গোপনে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায় এবং বর্তমানে সেখানেই আত্মগোপন করে আছে। এদিকে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক ২০১৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন।) তুষখালী বাজারে এক জনসভায় মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে পাকিস্তানের শত্রু আখ্যায়িত করে তাদের ধ্বংস করার ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে হাবিলদার আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস ও নায়েক মোতালেব শরিফকে হত্যা অথবা আটকের নির্দেশ দেয়। ঐদিন বিকেলে মঠবাড়িয়া থানার এএসআই মাহাবুবের নেতৃত্বে পুলিশ ও শান্তি কমিটির সদস্যরা ফুলঝুড়ি গ্রামে অভিযান চালাতে গেলে ঐ দুই মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে এএসআই মাহাবুবসহ তিনজন পুলিশ ও জবেদ আলী চৌকিদার নামে একজন নিহত হয় এবং পুলিশের গুলিতে মোতালেব শরিফ শহীদ ও আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস আহত হন। ২০শে এপ্রিল আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস মারা যান। এলাকাবাসী এ ঘটনাকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে।
১৭ই মে পাকবাহিনী পিরোজপুর থেকে মঠবাড়িয়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশনের ছাত্রাবাস ও ওয়াপদা অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐদিনই তারা গানবোটে করে তুষখালী হয়ে ফুলঝুড়ি গ্রামে এসে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় লুণ্ঠন চালায়। লুণ্ঠনশেষে শহীদ মোতালেব শরিফের মৃতদেহ এবং আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাসের বাড়িসহ ৩৬০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। একই দিন তারা সারদা পাইক নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করে। রাজাকাররা মঠবাড়িয়া থানায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মঠবাড়িয়ায় মুসলিম লীগ- ও জামায়াতে ইসলামী-র সমর্থকদের নিয়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। থানা শান্তি কমিটির প্রথম সভাপতি ছিল খান সাহেব হাতেম আলী জমাদ্দার। কিন্তু কমিটির সদস্যরা হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ শুরু করলে তিনি পদত্যাগ করেন। তার স্থলে সভাপতি হয় আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার। শান্তি কমিটির সদস্যদের মধ্যে আমির হোসেন ওরফে আলী মৃধা (বড়মাছুয়া), নূর হোসেন চেয়ারম্যান (পিতা তোমেজ উদ্দিন মৃধা, বড়মাছুয়া; সাপলেজা ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি), শাহাদত হোসেন (চরখগাছিয়া), আরশেদ আলী হাওলাদার (মিঠাখালী), নাসির উদ্দিন মঞ্জু (মিঠাখালী), ডা. আনিসুর রহমান (মঠবাড়িয়া), হেমায়েত সুফী (আলগী পাতাকাটা), জুলফিকার আলী শরিফ (তুষখালী), মোদাচ্ছের মৃধা (বড়মাছুয়া), তোতাম্বর হোসেন (উত্তর সোনাখালী), সাইদুর রহমান সৈয়দ (মিঠাখালী), মোয়াজ্জেম মৃধা (বড়মাছুয়া), রুহুল আমিন মৃধা (সোনাখালী), শামসুল আলম মৃধা (টিকিকাটা), মোজাম্মেল হক (বকসির ঘটিচোরা), আবতাফ উদ্দিন (টিয়ারখালী), কুটি ফরাজী (দক্ষিণ গুলিসাখালী), আজাহার মৃধা (টিকিকাটা) বাহার আলী হাওলাদার (টিয়ারখালী), আব্দুর রশিদ (মিঠাখালী), আব্দুল হামিদ খাঁ (জয়নগর), হারুন-অর-রশিদ (ভাইজোড়া), আনিসুর রহমান (হোতখালী), ছোমেদ আলী (বকসির ঘটিচোরা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কুখ্যাত রাজাকারদের মধ্যে ইস্কান্দার আলী মৃধা (পিতা ইসমাইল মৃধা, টিকিকাটা; মঠবাড়িয়া থানা রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার), সেকান্দার মৃধা (টিকিকাটা), মতি, হাওলাদার (জানখালী), সুলতান মুন্সী (ধূপতি), মুকুল আহমেদ বাদশা (সোনাখালী), আনসার আলী খলিফা (মিঠাখালী), চাঁন মিয়া দরজি (সাপলেজা) প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী ১৬ই এপ্রিল তুষখালীর নাথপাড়া ও কুলুপাড়ায় শতাধিক হিন্দু বাড়িতে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। ১৭ই এপ্রিল পাকবাহিনী তাদের সহযোগিতায় আমড়াগাছিয়া বাজার, মঠবাড়িয়া বাজার ও যুগীবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এ-সময় তারা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংগ্রাম কমিটির নেতা ডা. মতিউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল খালেকের বাড়িসহ সংগ্রাম কমিটির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খেজুরবাড়িয়া গ্রামের ৬০-৭০ জন, ফুলঝুড়ি গ্রামের দুশতাধিক ও টিকিকাটাসহ বিভিন্ন গ্রামের আরো শতাধিক হিন্দুকে আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার ও তার সহযোগীরা জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। শুধু তাই নয়, পাকবাহিনীর এই দোসরদের সহযোগিতায় দীপ্তি রাণী (ফুলঝুড়ি), হাসি রাণী (বড়মাছুয়া), কল্যাণী রাণী (বড়মাছুয়া), শ্রীমতী রাণী পাল (সোনাখালী বাজার)-সহ অনেক নারীর সম্ভ্রম হানি করে।
৫ই মে গণপতি হালদার (বকসির ঘটিচোরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র), আনোয়ারুল কাদির (দক্ষিণ সাপলেজা), জিয়াউজ্জামান (২নং ওয়ার্ড, মঠবাড়িয়া পৌরসভা), ফারুকউজ্জামান (২নং ওয়ার্ড, মঠবাড়িয়া পৌরসভা), আব্দুল মালেক মুন্সী (পাতাকাটা), গোলাম মোস্তফা (চিত্রা), নূরুল ইসলাম বিএসসি (সোনাখালী), শামসুর রহমান বেপারী (রায়েন্দা), জাকির হোসেন (মিঠাখালী), অমল মণ্ডল (দেবত্র), বীরেন্দ্রনাথ মণ্ডল (দেবত্র) প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা মঠবাড়িয়া সদরে বসে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন মঠবাড়িয়া থানার সিআই জালাল খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানপন্থী পুলিশ বাহিনী তাঁদের আটক করে মঠবাড়িয়া থানায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে ফারুকউজ্জামান, নূরুল ইসলাম বিএএসসি ও জাকির হোসেন ছাড়া পান। অন্য আটজনকে ৯ই মে পিরোজপুর হানাদার ক্যাম্পে চালান করে দেয়া হয়। ১০ই মে পাকবাহিনী তাদের বলেশ্বর নদের চানমারী খেয়াঘাটে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে, যা চানমারী খেয়াঘাট গণহত্যা নামে পরিচিত|
২২শে মে আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার, ইস্কান্দার আলী মৃধা, নূর হোসেন চেয়ারম্যান, শাহাদত হোসেন ও চাঁন মিয়া দরজির নেতৃত্বে চার শতাধিক পাকিস্তানপন্থী সাপলেজা ইউনিয়নের বাড়ৈবাড়িতে সশস্ত্র হামলা চালায়। তারা ৭০টি বাড়িতে লুটপাট শেষে অগ্নিসংযোগ করে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। হত্যার এ ঘটনা বাড়ৈবাড়ি গণহত্যা নামে পরিচিত। ৮ই জুন রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী বড়মাছুয়া গ্রামের ৭ জনকে হত্যা করে। ১২ই জুন তারা আবার এ গ্রামে হানা দিয়ে আরো ৭ জনকে হত্যা করে। এ ঘটনা বড়মাছুয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
৯ই অক্টোবর গভীর রাতে রাজাকার কমান্ডার ইস্কান্দার আলী মৃধা, রাজাকার মুকুল আহমেদ বাদশা, আনসার আলী খলিফা ও সৈয়দ হাওলাদার (জানখালী)-এর সহযোগিতায় পাকবাহিনী আঙ্গুলকাটা গ্রামের মিস্ত্রিপাড়া ও হাওলাদার বাড়িতে অভিযান চালায়। সেদিন তারা ঘুমন্ত মানুষদের ঘর থেকে টেনে বের করে টিকিকাটা ইউনিয়নের সূর্যমণি বেড়িবাঁধের সুইস গেটের পাশে নিয়ে হত্যা করে। সূর্যমণি সুইস গেট গণহত্যা~য় ২৫ জন নিরপরাধ মানুষ শহীদ হয়। ২৬শে অক্টোবর সাংরাইল এলাকায় আরেকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। এদিন মতি হাওলাদার ও সুলতান মুন্সীর নেতৃত্বে প্রায় ৩০ জন সশস্ত্র রাজাকার আমড়াগাছিয়া ইউনিয়নের কালিকাবাড়ি গ্রামের ৭ জন নিরীহ মানুষকে সাংরাইল খালের পাড়ে নিয়ে হত্যা করে।
মঠবাড়িয়া থানার সামনে ওয়াপদা কলোনি ও কে এম লতিফ ইনস্টিটিউশনের ছাত্রাবাস পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল।
মঠবাড়িয়া উপজেলা ৯ নং সেক্টরের সুন্দরবন ও বুকাবুনিয়া সাব-সেক্টরের অধীনে ছিল। সুন্দরবন সাব-সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন জিয়া উদ্দিন আহমেদ এবং বুকাবুনিয়া সাব- সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর মেহেদি আলী ইমাম, বীর বিক্রম। তবে মঠবাড়িয়ায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো যুদ্ধ হয়নি। ১৮ই ডিসেম্বর মঠবাড়িয়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য মঠবাড়িয়া উপজেলার দুজন মুক্তিযোদ্ধা ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তাঁরা হলেন- মেজর (অব.) মেহেদি আলী ইমাম, বীর বিক্রম (পিতা এম এন বিল্লাহ, দাউদখালী) এবং হাবিলদার আনিছ মোল্লা, বীর বিক্রম (পিতা তছিল উদ্দিন, খয়েরঘটিছড়া)। মঠবাড়িয়া উপজেলায় ১৪ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন— হাবিলদার আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস (পিতা আমজাদ আলী বিশ্বাস, ফুলঝুড়ি), নায়েক মোতালেব শরিফ (পিতা নজর আলী শরিফ, ফুলঝুড়ি), মো. আবু মিয়া (পিতা সোনা মিয়া, পাঁচশতকুড়া), জিয়াউজ্জামান (পিতা মতিউর রহমান, ২নং ওয়ার্ড, মঠবাড়িয়া পৌরসভা), আনোয়ারুল কাদির (পিতা এলেম উদ্দিন, দক্ষিণ সাপলেজা), গণপতি হালদার (পিতা নগেন্দ্রনাথ হালদার, বকসির ঘটিচোরা), গোলাম মোস্তফা (পিতা আজাহার আলী, চিত্রা), আব্দুল মালেক মুন্সী (পিতা আব্দুল গণি মুন্সী, পাতাকাটা), অমল মণ্ডল (পিতা পরীক্ষিত মণ্ডল, দেবত্র), মো. আব্দুল আজিজ (পিতা আমজাদ আলী, ফুলঝুড়ি; সেনাসদস্য, কুমিল্লায় শহীদ), মানিক মিয়া (পিতা জামাল উদ্দিন আকন, পশ্চিম সেনের টিকিকাটা; সেনাসদস্য, যশোরে শহীদ), মোসলেম আলী খান (পিতা আসমত আলী খান, ফুলঝুড়ি; সেনাসদস্য, চট্টগ্রামে শহীদ), মো. হাবিবুর রহমান (পিতা মোফাজ্জেল আলী খান, জরিপের চর; সেনাসদস্য, রাজশাহীতে শহীদ) এবং রুহুল আমীন খন্দকার (পিতা আব্দুল মান্নান খন্দকার, বেতমোড়; সেনাসদস্য, কুমিল্লার আখাউড়ায় শহীদ)।
মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের ধর্ষণের শিকার মঠবাড়িয়ার বেতমোড়, বড়মাছুয়া, সোনাখালী, কবুতরখালী ও ফুলঝুড়ি গ্রামের ১৩ জন হিন্দু নারীর নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁদের মধ্যে চারজন হলেন— দীপ্তি রাণী (ফুলঝুড়ি), হাসি রাণী (বড়মাছুয়া), কল্যাণী (বড়মাছুয়া) ও শ্রীমতী রাণী পাল (সোনাখালী)। অন্যদের নাম ও পরিচয় মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদে সংরক্ষিত আছে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক সওগাতুল আলম সগির এমপিএ ১৯৭৩ সালের ৩রা জানুয়ারি আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে তাঁর একটি ম্যুরাল নির্মিত হয়েছে। মঠবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডানপাশে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। চিত্রা গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফার নামে মঠবাড়িয়া সদরে ‘কে এম লতিফ ইনস্টিউিটশন খেলার মাঠ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ মোস্তফা খেলার মাঠ’ রাখা হয়েছে। [এ কে এম ফয়সাল প্রিন্স]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!