You dont have javascript enabled! Please enable it! কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ - সংগ্রামের নোটবুক

কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ

মণি সিংহ (১৯০১-১৯৯০) কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা, কৃষক ও আদিবাসী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব, দীর্ঘ কারাবরণকারী, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় নিবেদিতপ্রাণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকার-এর উদ্যোগে গঠিত সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য এবং ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন-এর যৌথ গেরিলা বাহিনীর অন্যতম সংগঠক। ১৯০১ সালের ২৮শে জুলাই কলকাতয়
তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম কালী কুমার সিংহ এবং মাতার নাম সরলা দেবী। ৭ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। ময়মনসিংহের নেত্রকোনার সুসং দুর্গাপুরে ছিল তাঁর মাতুলালয়। মা ছিলেন জমিদার বংশের। স্বামীর মৃত্যুর পর সরলা দেবী শিশু পুত্রকে নিয়ে পিত্ৰালয় চলে আসেন।
কিশোর বয়সেই মণি সিংহ বিপ্লবীদের ‘অনুশীলন’ দলে যোগ দেন। স্কুলে অধ্যয়নকালে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লব ও এর আদর্শ দ্বারা সে-সময় ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ হন। ১৯২১ সালে তিনি গান্ধীর ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এ-সময় কিছুকাল তিনি কলকাতয় শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৩০ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ৫ বছর পর ১৯৩৫ সালে মুক্তি পান। এরপর তিনি সুসং দুর্গাপুরে এসে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষক-ক্ষেত মজুরদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এবার দেড় বছরের জন্য তাঁর জেল হয়। জেল থেকে ১৯৩৭ সালে মুক্তিলাভ করে তিনি ময়মনসিংহের ঐ অঞ্চলের কৃষক ও গাড়ো হাজং আদিবাসীদের টংক প্রথাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি কিছুদিনের জন্য গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় নিখিল ভারত কৃষাণ সভার যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, কমরেড মণি সিংহ তার অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান। ছিলেন। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির ১৩ জন সদস্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁদের মধ্যে কমরেড মণি সিংহও – ছিলেন, যদিও তিনি অকৃতকার্য হন। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলা সদরের এক অংশ নিয়ে তাঁর নির্বাচনী এলাকা ছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫১ সালে মণি সিংহ পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নতুন রাষ্ট্রে জনগণের অধিকার ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার নবপর্যায়ের সংগ্রামে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। এজন্য তাঁকে জেল-জুলুম-হুলিয়াসহ শাসকগোষ্ঠীর দমন- পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ২৪ বছরের মধ্যে প্রায় ২০ বছর তাঁকে আত্মগোপনে কাটাতে হয়। বাকি অধিকাংশ সময় কাটে কারাগারে। ১৯৬৭ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান-কালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পেলেও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার তাঁকে পুনরায় কারাবন্দি করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপর অন্য বন্দিদের সহায়তায় তিনি রাজশাহী জেল ভেঙ্গে বেরিয়ে এসে পদ্মা পার হয়ে ভারতে যান। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সমর্থন-সহযোগিতা আদায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতাদানের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর উদ্যোগে স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতিনিধিদের নিয়ে ৮ সদস্যবিশিষ্ট যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছিল, তিনি তার অন্যতম সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের কয়েক হাজার গেরিলা নিয়ে গঠিত বিশেষ বাহিনীর তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা ও সংগঠক। উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রশ্নে ১৯৬১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- কমরেড মণি সিংহ ও খোকা রায়ের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের কংগ্রেসে মণি সিংহ পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। একই বছর উগ্র বামপন্থী ও স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী তৎপরতা মোকাবিলা করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ-এর উদ্যোগে ত্রিদলীয় গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট গঠিত হলে, তাঁর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি তাতে যোগ দেয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকালে ৭৭ বছর বয়সে কমরেড মণি সিংহকে কারাবরণ করতে হয় এবং ৬ মাস তিনি কারাগারে অন্তরীণ থাকেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক কমরেড মণি সিংহ- কে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করা হয়। জীবন-সংগ্রাম তাঁর রাজনৈতিক জীবনী-গ্রন্থ। ১৯৯০ সালের ৩১শে ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম অনিমা সিংহ। তাঁদের এক পুত্র সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: মণি সিংহ, জীবন সংগ্রাম, ঢাকা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড