You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে মতলব উত্তর উপজেলা (চাঁদপুর) - সংগ্রামের নোটবুক

মুক্তিযুদ্ধে মতলব উত্তর উপজেলা (চাঁদপুর)

মতলব উত্তর উপজেলা (চাঁদপুর) মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর মহকুমার মতলব থানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২০০০ সালের ৩০শে এপ্রিল ১৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে এ উপজেলা গঠিত হয়। এর চতুর্দিক নদীবেষ্টিত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এখানকার জনগণ ছিল সোচ্চার। ১৯৭০-এর নির্বাচনে এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণ আওয়ামী লীগ-এর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয়ী করে। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ ও এর প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কাছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বঙ্গবন্ধু এর বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন-এর ডাক দেন। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণ এ স্বাধীনতার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পেয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ অন্যান্য অঞ্চলের মতো মতলব উত্তরের জনগণও সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চ লাইট-এর নামে পাকহানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা শুরু করলে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তখন বৃহত্তর মতলব থানায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ ২৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অবঃ) এ বি সিদ্দিক এমপিএ এ পরিষদের আহ্বায়ক এবং গোলাম মোর্শেদ ফারুকী এমপিএ সদস্য- সচিব হন। সংগ্রাম পরিষদের অন্য সদস্যরা হলেন- আবদুর রহমান সাহিত্যরত্ন, ডা. মো. ইউনুছ, আলতাফ হোসেন খান, আবদুল হক মাস্টার, জয়নাল আবেদীন প্রধান, মোহাম্মদ আলী, প্রকৌশলী ইদ্রিস মিয়া, গাজী আলী আকবর, আলাউদ্দিন মিয়া, আবুল হোসেন খন্দকার, মো. শহীদ উল্যাহ মিয়া, সামছুল আলম চুনু মিয়া, দানু সরকার, মৌলভী আবদুস ছামাদ পাটোওয়ারী, নুরুল ইসলাম, মোস্তফা মিয়া, রিয়াজ উদ্দিন ওরফে মানিক স্যার, মোশারফ হোসেন তালুকদার, মৌলভী রজ্জব আলী, আ. মালেক সরকার, আ. লতিফ পাঠান, মজিদ প্রধান, খালেক সরকার, সিরাজুল ইসলাম, অলি উল্যাহ সরকার প্রমুখ। এ-সময় নুরুল ইসলাম নুরুর নেতৃত্বে মতলব থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে থানা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ একাত্মতা ঘোষণা করেন।
এ কমিটির অধীনে পরবর্তীতে প্রতিটি ইউনিয়নে একজন আহ্বায়ক ও একজন সদস্য-সচিবসহ ৭ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ কমিটি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ এলাকার ছাত্র, যুবক, কৃষক ও অন্যান্য পেশার লোকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে। ২৬শে মার্চের পর সংগ্ৰাম পরিষদ উপজেলার ওটারচর হাইস্কুল (গজরা), গোনিয়ারপাড় দত্তবাড়ি, সুজাতপুর বাজার সংলগ্ন নেছারিয়া হাইস্কুল, আড়ং বাজার, মাথাভাঙ্গা হাইস্কুল (মোহনপুর), নিশ্চিন্তপুর গ্রাম (দুর্গাপুর) প্রভৃতি এলাকায় সাময়িকভাবে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে।
এ সকল ক্যাম্পে লেফটেন্যান্ট এম এ ওয়াদুদ (সুজাতপুর), সুবেদার আবদুল লতিফ, হাবিলদার মো. মহিউদ্দিন, সার্জেন্ট আব্দুল আজিজ, কর্পোরাল আব্দুল কুদ্দুস, হাবিলদার আব্দুল আজিজ প্রমুখ প্ৰশিক্ষণ দেন। পরবর্তী সময়ে এখানকার মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে যান। সেখানে তাঁরা ২ সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্রসহ দেশে ফিরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধকালে মতলব উত্তর উপজেলায় নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী গড়ে ওঠে, যেমন- এমএফ, এফএফ ও বিএলএফ। এমএফ কমান্ডার ছিলেন এম এ ওয়াদুদ (সুজাতপুর)। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ কোরের একজন লেফটেন্যান্ট ছিলেন। তাঁর সহকারী ছিলেন সুবেদার আবদুল লতিফ, হাবিলদার মো. মহিউদ্দিন, সার্জেন্ট আব্দুল আজিজ, কর্পোরাল আব্দুল কুদ্দুস, হাবিলদার আব্দুল আজিজসহ প্রায় ১২০ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য। এফএফ কমান্ডার ছিলেন প্রথমে মিয়া মো. জাহাঙ্গীর (ইছাখালী), পরে কবির আহম্মদ খান (নিশ্চিন্তপুর) এবং সহকারী ছিলেন কমান্ডার মো. বদিউজ্জামান (চান্দ্রাকান্দি) ও শহীদুল আলম রব (মোহনপুর)। বিএলএফ কমান্ডার ছিলেন এম এ খালেক (রসুলপুর), ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন মো. ওবায়েদ উল্যাহ (মান্দারতলী) এবং সহকারী কমান্ডার ছিলেন প্রকৌশলী লোকমান হোসেন (বারআনী) ও দেওয়ান মো. সোলেমান (উত্তর ছেংগারচর)। নৌ কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. সেলিম খান (ফরাজিকান্দি)।
এপ্রিলের প্রথমদিকে পাকবাহিনী চাঁদপুর সদরে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এপ্রিলের শেষের দিকে প্রায় শতাধিক পাকসেনা ভারী অস্ত্র ও গোলা-বারুদ নিয়ে মতলব থানা সদরে পৌঁছে ক্যাম্প স্থাপন করে। মতলব উত্তর উপজেলাটি যেহেতু চারদিকে নদীবেষ্টিত, সেহেতু পাকসেনারা এখানে ক্যাম্প স্থাপন না করলেও মাঝে-মধ্যে মতলব থানা ক্যাম্প থেকে গানবোটে এসে মেঘনা-ধনাগোদা নদীর দুই তীরের গ্রামগুলোতে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে জ্বালাও-পোড়াও ইত্যাদির মাধ্যমে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। পাকবাহিনী অনুপ্রবেশকালে প্রাথমিক প্রতিরোধ হয়নি। তবে তাদের অতর্কিত আক্রমণের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ২১শে জুলাই মতলব থানা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। আক্রমণে পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন।
মতলব উত্তর উপজেলায় কতিপয় কুখ্যাত ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করলেও অধিকাংশ জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। এ কারণে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এ উপজেলায় সংগঠিত হতে পারেনি। তথাপি পাকবাহিনীর মতলব থানায় ক্যাম্প স্থাপনের পর তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এপ্রিলের শেষের দিকে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। মো. ওয়ালিউল্যাহ পাটোয়ারী (মতলব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক)-কে সভাপতি এবং হযরত আলী ছৈয়াল (শোভনকর্দী)-কে সাধারণ সম্পাদক করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে মুসলিম লীগ-এর সদস্যদের সমন্বয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটি ছাড়াও মে মাসের শেষের দিকে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ঢাকিরগাঁয়ের সুলতান মিয়া মতলব থানার পশ্চিম অঞ্চলের এবং সদরের আব্দুল মান্নান পূর্বাঞ্চলের রাজাকার কমান্ডার ছিল। তাদের সহযোগী ছিল ভাঙ্গারপাড়ের মুসলিম মেম্বার, নবকলসের আমজাদ আলী প্রধান, উপাদীর গোলাপ খান, বাইশপুরের মজু বেপারী, সেকান্দার হায়াত, মালেক দেওয়ান, লুধুয়ার বাচ্চু মিয়া, কদমতলীর আ. লতিফ প্রধান, বারেক দরবেশ, দিঘলদীর মাইজা মাল, নলুয়ার আবিদ মোল্লা, ফতেপুরের লালু চৌধুরী, কলাদীর নোয়াব মিয়া, দগরপুরের জব্বর দেওয়ান এমুখ। এরা পাকবাহিনীর সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন স্থানে হত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায়।
সড়কপথে মতলব উত্তরে প্রবেশের কোনো সুযোগ না থাকায় এখানকার জনগণ পাকবাহিনীর নির্যাতন থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিল। বরং এখানকার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নদীপথে পাকসেনাদের গানবোট অথবা জাহাজে অতর্কিতে আক্রমণ করে তাদের আতঙ্কিত করে রাখতেন। এতদ্সত্ত্বেও ২৫শে সেপ্টেম্বর পাকসেনা ও তাদের দোসররা গানবোটে এসে এনায়েতনগর ও সিপাইকান্দি গ্রামে আক্রমণ করে বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং মজিদ মাস্টার, হযরত আলী ও চানবানু বিবি নামে ৩ জনকে হত্যা করে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করলে তারা পিছু হটে মতলব থানা ক্যাম্পে চলে যায়।
মতলব উত্তর উপজেলায় পাকবাহিনীর কোনো নির্যাতনকেন্দ্র বা বন্দিশিবির ছিল না। মতলব থানা ক্যাম্পই ছিল তাদের নির্যাতনকেন্দ্র। এ ক্যাম্পে বিভিন্ন গ্রাম থেকে স্বাধীনতাকামী লোকজনদের ধরে এনে নির্যাতন, হত্যাসহ নারীদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হতো।
মতলব উত্তর উপজেলার হরিনা গ্রামে একটি গণকবর রয়েছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে গিয়ে কয়েকজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধ চলাকালে নদী অথবা খালে যে-সকল বেওয়ারিশ লাশ ভেসে আসত, তাদের সমাহিত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মতলব উত্তর উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকহানাদার বাহিনীর অনেকগুলো যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে নন্দলালপুর বাজার যুদ্ধ, গোয়ালমারী যুদ্ধ, নাছিরাকান্দি অপারেশন, কালিপুর বাজার যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। ১২ই আগস্ট পাকবাহিনীর সঙ্গে নন্দলালপুর বাজার যুদ্ধ হয়। ঘটনার দিন পাকবাহিনী নন্দলালপুর বাজার আক্রমণ করলে এমএফ কমান্ডার লে. এম এ ওয়াদুদের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের প্রতিহত করেন। দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধের পর পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষে কয়েকজন হতাহত হয়। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে কমান্ডার সেলিম খান ও শহীদুল আলম রবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এখলাছপুর-আমবাগের কাছে মেঘনা নদীতে পাকসেনাদের ৩টি মালবাহী জাহাজে আক্রমণ চালান। এতে এম ভি গফুর ও এম ভি সোবহান জাহাজ দুটি ডুবে যায় এবং এম ভি মাসুদ জাহাজটি মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ২৫শে সেপ্টেম্বর পাকসেনা ও তাদের দোসররা এনায়েতনগর- সিপাইকান্দি গ্রামে আক্রমণ করে অগ্নিসংযোগ করে। কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ও নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদারদের প্রতিহত করেন। সংবাদ পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদের নেতৃত্বে আরো একটি দল এসে সংঘবদ্ধভাবে তিনদিক থেকে আক্রমণ করে। সারাদিন গোলাগুলির পর পাকসেনারা পিছু হটে। এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষে অনেক হতাহত হয়। ২০শে নভেম্বর মতলব উত্তর-দাউদকান্দি সীমান্তে গোয়ালমারী (দাউদকান্দি) মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পাকবাহিনী আক্রমণ করলে সংঘর্ষ বাঁধে। সংবাদ পেয়ে কমান্ডার এম এ ওয়াদুদ, এফএফ কমান্ডার কবির আহম্মদ খান এবং পার্শ্ববর্তী থানা গজারিয়ার কমান্ডার ফজলুর রহমান ও দাউদকান্দি থানার কমান্ডারের যৌথ নেতৃত্বে প্রায় চারশত মুক্তিযোদ্ধা চারদিক থেকে পাকসেনাদের আক্রমণ করেন। প্রায় ২০ ঘণ্টা উভয় পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। গোয়ালমারী যুদ্ধে অর্ধ শতাধিক পাকসেনা নিহত এবং পাকসেনাদের মেজর আল আমিনসহ বেশ কয়েকজন ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন (দাউদকান্দি), নুরুল ইসলাম (দাউদকান্দি) ও শামসুল হকসহ ৭ জন শহীদ হন এবং কমান্ডার এম এ ওয়াদুদসহ ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ২২শে নভেম্বর মোহনপুর ইউনিয়নের নাছিরাকান্দি গ্রামের নিকট মেঘনা নদীতে পাকসেনারা গানবোটে করে টহল দিচ্ছিল। এ-সময় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুর রবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান। তাতে পাকসেনা বহনকারী লিলি নামের যুদ্ধ জাহাজটি ডুবে যায়। নাছিরাকান্দি অপারেশনে ৭ জন পাকসেনা ধরা পড়ে। ৪ঠা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগণ একযোগে চারদিক থেকে পাকসেনাদের মতলব থানা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ- সময় উভয় পক্ষে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকসেনারা নদী ও সড়ক পথে চাঁদপুর পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষে অনেক হতাহত হয়। মূলত এদিনই মতলব উত্তর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। ৮ই ডিসেম্বর চাঁদপুর শহর ছেড়ে পাকবাহিনী নদীপথে ঢাকা অভিমুখে পালানোর সময় মোহনপুরের কাছে পৌঁছতেই -মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় জাহাজসহ তাদের অনেকেই নদীগর্ভে নিমজ্জিত হয়। কিছু পাকসেনা সাঁতরে তীরে উঠে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। পরে তাদের মিত্রবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করা হয়। একইদিনে কালিপুর বাজারের নিকটবর্তী মেঘনা নদীর পথ ধরে তিনটি গানবোটসহ পাকসেনারা নদীর দুই তীরের গ্রামগুলোতে গুলিবর্ষণ করতে-করতে ঢাকায় ফিরছিল। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কবির আহম্মদ খান, মোহাম্মদ আলী এবং বদিউজ্জামানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের লক্ষ করে পাল্টা গুলিবর্ষণ করেন। পাশাপাশি মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ১টি গানবোট ডুবে যায় এবং বাকি ২টি চরে আটকা পড়ে। কালিপুর বাজার যুদ্ধে উভয় পক্ষের অনেক হতাহত হয়। পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অনেক অস্ত্র ও গোলা-বারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। পরবর্তীতে আত্মসমর্পণকৃত পাকসেনাদের মিত্রবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর মতলব উত্তর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া-, ‘বীর বিক্রম’ (পিতা আলী আহমেদ মিয়া, মোহনপুর) এবং আবু তাহের, বীর প্রতীক (পিতা গোলাম আহমদ সিকদার, বড় হলদিয়া, ফরাজীকান্দি) ও তোবারক উল্লাহ, বীর প্রতীক (পিতা বসরত আলী মাস্টার, একলাসপুর)।
মতলব উত্তর উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুল আউয়াল (পিতা মো. চুনু ভূঁইয়া, চান্দ্রাকান্দি), সিরাজুল হক (পিতা নূরুল ইসলাম ভূঁইয়া, চান্দ্রাকান্দি), মো. দুদু মিয়া (পিতা কেরামত আলী বেপারী, চান্দ্রাকান্দি), মো. সাহাজ উদ্দিন (পিতা আলী হোসেন ভূঁইয়া, চান্দ্ৰাকান্দি), মঙ্গল খান (পিতা হাসমত উল্যাহ খাঁন, সাদুল্যাপুর), মোখলেছুর রহমান (পিতা গোলাম আলী, কলাকান্দা), মো. কালা মিয়া (পিতা আ. কাদের মুন্সী, উত্তর ছেংগারচর), মোরশেদ আলম (পিতা খলিলুর রহমান, খাগুরিয়া), মো. মুকবিল হোসেন (পিতা বাদশা মিয়া, রামপুরা), আক্তার হোসেন (পিতা আবদুল গনি দর্জি, দীঘলীপাড়), মো. ছিদ্দিকুর রহমান (পিতা চাঁন বক্স মিয়া, চরমাছুয়া), এম এ বারী সরকার (পিতা বেলায়েত আলী সরকার, হরিনা), আব্দুল হাই মিয়াজী (পিতা হারিছ মিয়া, মোহনপুর), মো. হযরত আলী সিকদার (পিতা ওয়াজউদ্দিন সিকদার, ছোট কিনাচক), মো. বজলুর রহমান (পিতা বসর উদ্দিন সরকার, পাঁচআনী), ফরিদ উদ্দিন (পিতা ফজলুল করিম মুন্সী, বড় ষাটনল), নুর মোহাম্মদ (পিতা মুন্সী আ. কাদের, মুন্সিরকান্দি), আব্দুস সাগর (পিতা রজব আলী ঢালী, আদুরভিটি), নান্নু মিয়া (পিতা জুনাব আলী সরকার, মাথাভাঙ্গা), আক্তার আলম (পিতা আলীম উদ্দিন প্রধান, মিলারচর), আব্দুর রাজ্জাক (পিতা হযরত আলী, কুমার খোলা), কামাল উদ্দিন (পিতা ইব্রাহীম বেপারী, সুগন্ধি), হাওলাদার আ. সালাম (পিতা আবিদ আলী, সুগন্ধি), কবির আহমেদ (পিতা ফজলুল করিম চৌধুরী, এখলাছপুর), মো. ইসমাইল (পিতা করিম উল্যাহ, সুজাতপুর) এবং ইসহাক সিকদার (বদরপুর)।
মতলব উত্তর উপজেলায় একটি মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। হরিণায় একটি গণকবর চিহ্নিত করা আছে। ছেংগারচর ডিগ্রি কলেজ সংলগ্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স স্থাপন করা হরা হয়েছে। ছেংগারচর-মতলব এবং উপজেলা সদর থেকে কালিপুর সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মায়া বীর বিক্রম সড়ক। উপজেলা কমপ্লেক্স অডিটোরিয়াম ও পৌর অডিটোরিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে মায়া বীর বিক্রম অডিটোরিয়াম। রাঢ়ীকান্দি- নবুরকান্দি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আক্তার হোসেন সড়ক। অস্বচ্ছল ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বীর নিবাস নামে একটি আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। [আহসান উল্যাহ সরকার]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড