You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে মতলব দক্ষিণ উপজেলা (চাঁদপুর)

মতলব দক্ষিণ উপজেলা (চাঁদপুর) পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা আর বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য যখন চরমে, তখন মাতৃভূমিকে এসবের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য বাঙালি জাতির মনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। সমগ্র জাতি দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রস্ততি নেয়। ১৯৭০-এর নির্বাচনে এ অঞ্চলের আপামর জনসাধারণ আওয়ামী লীগ-এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায় এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর কাছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। এরূপ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ এ স্বাধীনতার দিক-নির্দেশনা পেয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সমগ্র দেশের মতো মতলব দক্ষিণ উপজেলার জনগণও সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়। তারা পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য সংগঠিত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করা ও চাঁদপুর অঞ্চলকে হানাদারমুক্ত রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে ২৮শে মার্চ চাঁদপুর শহরের টাউন হলে একটি প্রস্তুতিসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ (চাঁদপুর), এডভোকেট সিরাজুল হক এমপিএ (ফরিদগঞ্জ), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিক এমপিএ (মতলব), আবদুল করিম পাটোয়ারী এমপিএ (চাঁদপুর), ডা. আব্দুস সাত্তার এমপিএ (হাজীগঞ্জ), আবদুর রব (হাজীগঞ্জ; সভাপতি, চাঁদপুর মহকুমা আওয়ামী লীগ), মো. ওয়ালী উল্লাহ এমএনএ (ফরিদগঞ্জ), রাজা মিয়া এমপিএ (ফরিদগঞ্জ), সিকান্দার আলী এমপিএ (কচুয়া), হাফেজ হাবিবুর রহমান (মতলব-বোরোচর) এমএনএ ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম মোর্শেদ ফারুকী এমপিএ (মতলব), এডভোকেট আব্দুল আউয়াল এমএনএ (কচুয়া), আবু জাফর মইনুদ্দিন (হাজীগঞ্জ; আওয়ামী লীগ নেতা)-সহ আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যক সমর্থক, কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিল। ঐ সভা থেকেই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) এ বি সিদ্দিককে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়।
৬ই এপ্রিল নারায়ণপুর গ্রামের সৈয়দ আবদুল মান্নানের বাড়িতে মতলব উপজেলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদে আতিকুর রহমান (রামদাসপুর)-কে সভাপতি এবং জয়নাল আবেদীন প্রধান (শোভনকর্দি)-কে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এ কমিটিতে আরো ছিলেন মোশারেফ হোসেন তালুকদার (শাহপুর), লাল মিয়া পাটোয়ারী (কাঁচিয়ারা), সৈয়দ আব্দুল মান্নান (নারায়ণপুর), জয়নাল আবেদীন পাটোয়ারী (বদরপুর), নূরু মেম্বার (নওগাঁও), আব্দুল লতিফ পাঠান (নওগাঁও), ডা. কে এম ইউনুছ (বহরী), আলী আহমেদ মাস্টার (বহরী), আবুল হাশেম মাস্টার (ডিঙ্গাভাঙ্গা), আব্দুল খালেক (ধনাগোদা), সিরাজুল ইসলাম (ধনাগোদা), আবদুল হক (ইমামপুর), আমির হোসেন (ষাটনল), আব্দুর রহমান সাহিত্যরত্ন (ষাটনল), বোরহান উদ্দিন (মান্দারতলী-নাউরী), ডা. নুরুল ইসলাম (লুধুয়া), আলতাফ হোসেন (লুধুয়া) প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদের মূল দায়িত্ব ছিল পাড়া, মহল্লা, ওয়ার্ড ও গ্রামগঞ্জ থেকে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, মুক্তিকামী জনতাকে সংগঠিত করে মুক্তি সংগ্রামের প্রাথমিক ধারণা দেয়া, তাদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারতের আগরতলায় পাঠানো, ভারত থেকে যেসব প্রতিরোধযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্রসহ দেশের ভেতরে প্রবেশ করেছেন, তাঁদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা এবং সুবিধাজনক নিরাপদ অবস্থানে রেখে স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৮ই এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা এম এ ওয়াদুদ মতলব বাজারে বাচ্চু মিয়ার হোটেলে উড্ডীয়মান পাকিস্তানি পতাকা গুলি করে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেন। তিনি বাচ্চু মিয়াকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে ফেলতে বাধ্য করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য তাঁরা উপজেলার নওগাঁও মিজি বাড়ি (মাদ্রাসার পশ্চিম দিকে), বহরী কাজী বাড়ি ও খান বাড়ি, বোয়ালিয়া বাড়ি (বাজারের দক্ষিণ পাশে), আশ্বিনপুর হাইস্কুল ও খিদিরপুর (নায়েরগাঁও দক্ষিণ)-এ ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ- সকল ক্যাম্প স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিবাহিনীর জওয়ানদের নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা, এলাকার মুক্তিকামী যুবকদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এসব ক্যাম্পে অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাসদস্য, ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর লোকজনসহ সামরিক বিষয়ে যাঁদের দক্ষতা ছিল তাঁরা প্রশিক্ষণ দিতেন। ক্যাম্প স্থাপনে সুবেদার জহিরুল হক (বরিশাল), সিরাজ বকাউল (পৈলপাড়া) ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের নায়েক সেলিম (বরুড়া) উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
মতলব দক্ষিণ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের এমএফ কমান্ডার ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলন্দাজ কোরের লেফটেন্যান্ট এম এ ওয়াদুদ (সুজাতপুর)। এফএফ কমান্ডার হিসেবে কবির আহম্মেদ খান (নিশ্চিন্তপুর) দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া নেছার উদ্দিন আহম্মেদ (মৈশাদী), সাইদুর রহমান রতন (বহরী), হাফেজ মোহাম্মদ আলী (বাগান বাড়ি), শহিদুল আলম রব (মোহনপুর), মোয়াজ্জেম হোসেন (এনায়েতনগর), আব্দুল খালেক (রসুলপুর), মিয়া মো. জাহাঙ্গীর (ইছাখালি), এনামুল হক বকাউল (পৈলপাড়া), জহির উদ্দিন বাবর (রাঢ়ীকান্দি), ওবায়েদুর রহমান (মান্দারতলী-নাউরী), এম ওয়াদুদ (নন্দলালপুর) প্রমুখ সহকারী কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন।
১২ই মে মতলব বাজারে আব্দুস ছাত্তার চৌধুরী (বাইশপুর)-র তিনতলা ভবনের দোতলায় ছিল হাবিব ব্যাংক (পরবর্তীতে অগ্রণী ব্যাংক)। মতলব থানা থেকে ২০০ গজ পূর্বদিকে ছিল ভবনটির অবস্থান। রাত ১০টার দিকে সিরাজ বকাউলের নেতৃত্বে ৮-১০ জন মুক্তিযোদ্ধা এ বাসার ছাদে উঠে থানা লক্ষ করে অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকেন এবং প্রায় আধঘণ্টা পর এখান থেকে চলে যান। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি জানান দেয়া এবং পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা। পরদিন সকালে বাসার ছাদের ওপর অনেক গুলির খোসা, তাজা গুলি ও গুলির কার্টুন পাওয়া যায়।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে সড়কপথে হাজীগঞ্জ মহামায়ার পথ ধরে বাবুরহাট হয়ে চাঁদপুর শহরের টেকনিক্যাল হাইস্কুলে এসে ক্যাম্প স্থাপন করে। তারা দুদিন পর চাঁদপুর থেকে সড়ক পথে ৫-৭টি গাড়িতে করে হাটের দিন মতলব বাজারে আসে। বাজারের চারদিকে টহল দেয় এবং হিন্দু ব্যবসায়ীদের ‘মালাউনের বাচ্চা’ বলে উর্দুতে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। তারা এভাবে ঘণ্টাখানেক বাজারে অবস্থান করে চাঁদপুর ফিরে যায়।
২৫শে জুলাই সকাল ১১টার দিকে শতাধিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্য সড়কপথে চাঁদপুর শহর থেকে মতলব উপজেলায় অনুপ্রবেশ করে। তারা সুবেদার দামান আলীর নেতৃত্বে মতলবগঞ্জ জে বি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্প থেকেই তারা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে অত্যাচার, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালাত।
উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর অনুপ্রবেশের পর তাদের সহযোগিতা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শান্তি কমিটি -, রাজাকার বাহিনী, মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়। মতলব হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ওয়ালী উল্লাহ পাটওয়ারী (জয়শ্রী, ফরিদগঞ্জ)-কে সভাপতি এবং আবদুল মান্নান (সারপাড়)-কে সাধারণ সম্পাদক করে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটির উল্লেখযোগ্য সদস্যরা ছিল- আবদুল মান্নান চৌধুরী (ডিঙ্গাভাঙ্গা), সুলতান আহম্মেদ কাজী (বিবাহের কাজী), জলিল বেপারী (বাইশপুর), বাচ্চু মিয়া (লুধুয়া), জলিল মিজি (দগরপুর), জলিল মোল্লা (মোবারকদি), দেলোয়ার হোসেন (মধ্য দিঘলদী), মোকলেছুর রহমান (কৃষি কর্মকর্তা, নলুয়া), হযরত আলী ছৈয়াল (শোভনকর্দি), ডা. আব্দুল হক (ঘিলাতলী), আব্দুল লতিফ মাস্টার (টরকী), শুক্কুর মিয়া (উত্তর বিষ্ণুপুর, বরদিয়া আড়ং-এর পশ্চিম দিক) প্রমুখ। উপজেলার উল্লেখযোগ্য in রাজাকাররা হলো- সুলতান মিয়া (বারোঠালিয়া নাগাসী বাড়ি), মুসলিম মেম্বার (ভাঙ্গারপাড়), আমজাদ আলী ওরফে আনজু প্রধান (নবকলস প্রধানীয়া বাড়ি, ১নং ব্রিজ), গোলাপ খান (উপাদী), মজু ফরাজী (বাইশপুর), মাইজ্যা মাল (দিঘলদী), আবিদ মোল্লা (নলুয়া), আব্দুল লতিফ প্রধান (চরমুকুন্দি), আবুল হাশেম খান (সারপাড়), লেদুনি সরকার (বাইশপুর), বাচ্চু (বাইশপুর বাগানি বাড়ি), ধনু দেওয়ান (বাইশপুর), নুরু মাল (দিঘলদী), লালু (বরদিয়া), মোস্তফা (ফতেপুর), বুত্তা দফাদার (ভাঙ্গারপাড়), বাদশা মিয়া, মমিন আলী সরকার (ভাঙ্গারপাড়), সংসর আলী দেওয়ান (দক্ষিণ বাইশপুর), আবদুর বর (বারোঠালিয়া), লতিফ বকাউল (পৈলপাড়া), শুক্কুর আলী (দক্ষিণ বাইশপুর), সুরুজ ওরফে সিরাজ, আব্দুল মজিদ বাবুর্চি, আলী হোসেন, সুলতান আলদার, ওহাব আলী আলদার, হযরত আলী আলদার (দক্ষিণ বাইশপুর), আব্দুল রহিম, বদরুদ্দিন, রহিম আলী, দেরু প্রধানিয়া, ঝুড় প্রধানীয়া (চর বাইশপুর), সোবহান মিয়া (এনায়েত নগর), এনায়েত উল্লাহ, স্বপন মিস্ত্রি (চরমুকুন্দী), সেকান্দর, বাচ্চু (পশ্চিম বাইশপুর), মুকবিল গাজী, ছিট দেওয়ান, বিলাত আলী মিস্ত্রি (দক্ষিণ বাইশপুর), রহম আলী প্রধান, মোকলেছ প্রধান, নুরুল ইসলাম প্রধান (দক্ষিণ বাইশপুর), দুধ মিয়া, বাচ্চু মিয়া (লেবার, দক্ষিণ বাইশপুর), জলিল বেপারী, ছিড়া বেপারী (থানার দালাল, দক্ষিণ বাইশপুর, লুধুয়ার বাচ্চু রাজাকারের স্ত্রীর বড় ভাই) প্রমুখ। এছাড়া নোয়াব মিয়া (কলাদী)-কে সভাপতি এবং মালেক দেওয়ান (বাইশপুর)-কে সাধারণ সম্পাদক করে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করা হয়। এ বাহিনীর সদস্যরা ছিল- লালু চৌধুরী (ঠেটালিয়া চৌধুরী বাড়ি), সেকান্দার হায়াত (বাইশপুর), সামছুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার (খাদেরগাঁও), বারেক দরবেশ (চরমুকুন্দি), জব্বার দেওয়ান (দগরপুর), আবদুল কুদ্দুছ (দুর্গাপুর), সালাহউদ্দিন কাজী (মতলব সদর) প্রমুখ।
পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে রাজাকার বাহিনী এলাকায় সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করে। তারা এলাকায় অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকা- চালায় এবং নারীদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দিত, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের ধরে মতলব হাইস্কুল ক্যাম্পে নিয়ে আসত, বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মানুষের টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার ও গবাদি পশু লুট করত। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য মতলব বাজারের আব্দুস ছাত্তার চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে। ১৪ই মে তারা আবদুস ছাত্তার চৌধুরীকে বাজার থেকে আটক করে প্রথমে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে আটক আরো অজ্ঞাত ৫-৭ জনসহ আবদুস ছাত্তার চৌধুরীকে চাঁদপুরে নেয়ার কথা বলে ১৫ই মে বিকেলে দড়ি দিয়ে বেঁধে মতলব লঞ্চঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর গানবোটে তোলা হয়। রাতে মতলব পশ্চিম দিকের প্রশস্ত মেঘনা নদীতে সফরমালি-কানুদির কাছে গানবোট পৌঁছানোর পর প্রত্যেককে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে খুব কাছ থেকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়া হয়। তাঁদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বাইশপুরের গোল মাহমুদ সরকার বাড়ির গরীব হোসেন দারোগার ছেলে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার শাহজাহান সরকার টুলুকে রাজাকার বাহিনীর তৎপরতায় পাকিস্তানি বাহিনী আটক করে। রাতের বেলা নৌকায় করে কদমতলী-গাজীপুর নদীর মোহনায় তাকে মারার জন্য গুলি করলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী সুবেদার দামান আলী মতলবের কলাদী এলাকার বেজু সাহা, রাধাকৃষ্ণ মেম্বারের (রাধু মেম্বার) বাড়ির ত্রিনাথ সাহা (ত্রিনাইত্তা) ও তার স্ত্রীকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে। সে ত্রিনাথ সাহাকে খতনা করায়। দামান আলী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের দোকানপাট উচ্ছেদ করে পাকিস্তানি বাহিনীর সহজ যাতায়াতের জন্য মতলব বাজারের ফলপট্টি থেকে নোয়াব মিয়ার দোকানের পূর্বদিক দিয়ে নদীর পাড় পর্যন্ত একটি রাস্তা তৈরি করে।
রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী মতলব বাজারের আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুর রব ও আব্দুল মান্নানের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। তারা আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ বি সিদ্দিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার জন্য বাজারের ফলপট্টির হোটেল মোহাম্মদ আলী ও পৈলপাড়ার সফিক প্রধানিয়ার দোকান সম্পূর্ণরূপে পুড়িয়ে দেয়। এছাড়াও তারা মতলব পূর্ব বাজারের রহমান সরকার, জলিল সরকার, জলিল মিয়াজী, সিরাজ মুন্সি, রসিক লাল নাগ, ফজলুল হক ফরাজী, মাধব পাল, দুর্গাদাস পাল, হরেকৃষ্ণ পাল, অনুকূল সাহা ও আজিজ প্রধানিয়ার দোকান, ডা. আলি হোসেনের ফার্মেসি এবং সমবায় সমিতির ঘরসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে। পাকবাহিনী বরদিয়া আড়ং বাজারের জহিরুল হক (ঝাড়ু মিয়াজী), আব্দুর রব রাঢ়ী, ইমান আলী প্রধানিয়া ও আমির হোসেন ডাক্তারের দোকান লুট শেষে অগ্নিসংযোগ করে। তারা মুন্সিরহাট বাজার, নায়েরগাঁও বাজার, মাছুয়াখাল বাজার, নারায়ণপুর বাজার, নওগাঁও আড়ং বাজার, থানা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতা নূরুল হক আমিনের নওগাঁও গ্রামের বাড়ি, ভাঙ্গারপাড় রাঢ়ী বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর এ-সকল অপকর্মে সারপাড়ের মান্নান, বারোঠালিয়ার সুলতান, আব্দুর রব, নবকলসের আমজাদ (আনজু) রাজাকার ও তাদের সহযোগীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর মতলবগঞ্জ জে বি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ক্যাম্প ছিল নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির।
জুলাই মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সড়কপথে চাঁদপুর থেকে মতলব হাইস্কুল ক্যাম্পে আসার সময় বরদিয়া আড়ং বাজারের দক্ষিণ দিকের মসজিদের কাছে খালের পশ্চিম পাড়ে একজন অজ্ঞাতপরিচয় মুসলিম পান ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে। তারা সড়কপথে চাঁদপুর থেকে মতলবের দিকে আসার সময় বরদিয়া আড়ং বাজারের উত্তর দিকে মোন্দারহাট বাজারের খালের পশ্চিম পাড়ে আলী আকবরের দুই ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। আলী আকবর নৌকায় করে দুই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন।
সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চাঁদপুর থেকে সড়কপথে মতলবের দিকে আসার সময় মুন্সিরহাট বাজারের দক্ষিণ দিকে ব্রিজের ওপর একজন রিক্সাওয়ালা এবং সেকান্দার হাওলাদার নামে অপর একজনকে গুলি করে হত্যা করে। মতলব দক্ষিণ উপজেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। সেগুলোর মধ্যে লালার হাটখোলা যুদ্ধ, বরদিয়া আড়ং বাজার যুদ্ধ, নাগদা যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। নভেম্বরের প্রথম দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের লালার হাটখোলা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৬ জন সেনাসদস্য এবং কুখ্যাত রাজাকার সুলতান নিহত হয়। পাকবাহিনীর প্রচুর আধুনিক অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ-যুদ্ধে সুবেদার জহিরুল হকের সেকেন্ড ম্যান বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেলিম হাওলাদার (বরুড়া), সিরাজ বকাউল, এনামুল হক ও সাইদুর রহমান রতন নেতৃত্ব দেন।
৪ঠা ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রতিরোধের মুখে টিকতে না পেরে সড়কপথে মতলব থেকে চাঁদপুরের দিকে যেতে থাকে। এ-সময় মতলব সদর থেকে ৩ কিমি দক্ষিণে বরদিয়া আড়ং বাজার স্টিলের ব্রিজের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা আক্রমণ করে। উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত চাঁদপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এ-যুদ্ধে ছায়েদ মোল্লা (ঢাকিরগাঁও), মীর মান্নান (বরদিয়া), জয়নাল আবেদীন প্রধান (শোভনকর্দি)-সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধরা অংশগ্রহণ করেন। ৪ঠা ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নাগদা যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান (নাগদা) ও নওগাঁও গ্রামের একজন অজ্ঞাতপরিচয় তরুণ শহীদ হন। যুদ্ধে নেকবর প্রধানিয়া (মুন্সীরহাট), জয়নাল আবেদীন প্রধান (শোভনকর্দি), সিরাজুল ইসলাম বকাউল (পৈলপাড়া), সাইদুর রহমান রতন (মুন্সীরহাট), নাছির উদ্দিন পাটোয়ারী (মৈশাদী), নুরুল ইসলাম (এনায়েত নগর), শামসুল হক তালুকদার (নাগদা-মিরামা) প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
৪ঠা ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান মতলব দক্ষিণ উপজেলার বাইশপুরের চাঁন মিয়া সরকারের বাড়ির পূর্বদিকে কুমারডুলি খালের মুখে বিধ্বস্ত হয়। বিমানের পাইলট শহীদ হন। তাঁর বুকের বাম দিকে ইউনিফর্মের উপরে ‘JOY BANGLA’ লেখা ছিল। বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করতে আসা ভারতীয় এ বিমানসেনা মতলবের উত্তর-পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে চলা মেঘনা নদীর ষাটনল-গজারিয়া অংশে বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনাসহ দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকার দিকে পলায়নরত পাকিস্তানি বাহিনীর সারিবদ্ধ গানবোটের ওপর বোমাবর্ষণ করে একটি গানবোট সম্পূর্ণরূপে ডুবিয়ে দেন। দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে ফিরে আসার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ৪ঠা ডিসেম্বর মতলব দক্ষিণ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
মতলব দক্ষিণ উপজেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন- আব্দুস ছাত্তার চৌধুরী (বাইশপুর) ও আজিজুর রহমান (নাগদা)। মতলব দক্ষিণ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মতলব নিউ হোস্টেল মাঠের পশ্চিম পাশে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘দীপ্ত বাংলা’। উপজেলা অফিস সংলগ্ন পুকুরের পশ্চিম পাড়ের নামকরণ করা হয়েছে মায়া বীর বিক্রম চত্বর। ধনগোদা নদীর ওপর স্থাপিত সেতুর নামকরণ করা হয়েছে মায়া বীর বিক্রম সেতু। হাজীর ডোন থেকে কাজীর বাজার পর্যন্ত ৩.৫ কিমি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মায়া বীর বিক্রম সড়ক। [তৌহিদুল আলম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!