You dont have javascript enabled! Please enable it!

বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান কাঞ্চন

মজিবুর রহমান কাঞ্চন (১৯৩২-১৯৭১) শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা। নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও তিনি দুই সন্তানের জীবন বাঁচাতে শত্রুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর পিতার নাম আহছান উদ্দিন আহেমদ এবং মাতা তকদিরুন্নেছা। তিনি ১৯৩২ সালে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবার পেশকারের চাকরির সুবাদে তাঁরা বরিশাল শহরের বি এম স্কুলের সামনে কালিশ চন্দ্র রোডে স্থায়ী বাসিন্দা হন। তিনি বরিশাল বি এম স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে বি এম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ছাত্র অবস্থায় তিনি রাজনীতির সঙ্গথ জড়িয়ে পড়েন। একজন ভালো ফুটবল খেলোয়াড় এবং সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। কলেজে পড়াশুনাকালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরি নেন। কিন্তু বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণ তাঁকে ক্ষুব্ধ করে। এক পর্যায়ে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
তিনি ১৯৬০ এবং ১৯৬৮ সালে বরিশাল পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ-এর রাজনীতির সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে আসেন। বঙ্গবন্ধু কাঞ্চনকে আদর করে ‘ধলা কাঞ্চন’ বা ‘পাগলা’ বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধুর ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর বরিশালে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের তিনি একজন সদস্য ছিলেন। ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর বরিশাল শহর দখলের পূর্ব-পর্যন্ত তিনি সংগ্রাম কমিটির পক্ষে শহরের আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বি এম স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি ২৫শে এপ্রিল ঝুনাহার প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বরিশালে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের পর পাকিস্তানি বাহিনী আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। কৌশলগত কারণে এমএনএ, এমপিএ এবং নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করলেও মজিবুর রহমান কাঞ্চন গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার জন্য বরিশাল ছেড়ে যাননি। তাঁকে ধরার জন্য ৮ই মে রাজাকারদের সহায়তায় ক্যাপ্টেন জামিলের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর একটি দল তাঁর কালিশ চন্দ্র রোডের বাসা তল্লাশি করে। তাঁকে না পেয়ে তাঁর দুই পুত্র মশিউর রহমান কামাল ও শফিউর রহমান জামালকে বন্দি করে হানাদারদের ওয়াপদা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার সময় হানাদাররা মজিবুর রহমান কাঞ্চনকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়, না হয় দুই পুত্রসহ পরিবারের সকলকে হত্যা করা হবে মর্মে ঘোষণা করে। পরদিন মজিবুর রহমান কাঞ্চনকে সারেন্ডারের জন্য শহরে মাইকিং করা হয়। পুত্রদের জীবন বাঁচানোর অন্য কোনো উপায় না পেয়ে তিনি সারেন্ডারের সিদ্ধান্ত নেন। ১১ই মে সকালে তিনি মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় মৌলভী ডেকে তওবা করেন। এরপর বরই পাতা গরম জলে দিয়ে গোসল করে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পরিবারের সকলের সঙ্গে একত্রে নাস্তা করেন। নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে মজিবুর রহমান কাঞ্চন ১৬ দিনের শিশু পুত্রসহ পরিবারের সকলকে নিয়ে রিকশাযোগে পাকবাহিনীর ওয়াপদা ক্যাম্পে হাজির হন। পাকবাহিনী তাঁর পরিচয় নিশ্চিত হয়ে দুই ছেলেকে শেষবারের মতো তাঁকে দেখার সুযোগ দিয়ে ছেলেদের মুক্তি দেয়। দুদিন অমানুষিক নির্যাতনের পর ১৩ই মে রাতে পাক হানাদাররা গুলি করে হত্যা শেষে তাঁর লাশ সাগরদী খালে ভাসিয়ে দেয়। ১৪ই মে রাতে স্থানীয় ওয়াহেদ চেয়ারম্যানের সহায়তায় কয়েক ব্যক্তি শহীদ মুজিবর রহমান কাঞ্চনের লাশ মুসলিম গোরস্থানে সমাহিত করেন। তাঁর কবর বাঁধাই করে তাতে নামফলক লাগানো হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান কাঞ্চন স্মরণে কালিবাড়ি রোড ও বি এম স্কুল সংলগ্ন এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ কাঞ্চন পার্ক। অমৃত লাল দে সড়ক এবং কালিবাড়ি রোডের সংযোগ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান কাঞ্চন সড়ক। [মনিরুজ্জামান শাহীন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!