স্থানীয় মুক্তিবাহিনী মজিদ বাহিনী (ডুমুরিয়া, খুলনা)
মজিদ বাহিনী (ডুমুরিয়া, খুলনা) স্থানীয় একটি মুক্তিবাহিনী। এর প্রধান শেখ আবদুল মজিদ (১৯৩৯- ১৯৮৯)-এর জন্ম ডুমুরিয়া থানার খলশি গ্রামে। কৃষকনেতা হিসেবে তিনি এলাকায় পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিকভাবে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-র খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক। ১৯৭১ সালে তাঁর রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কিন্তু তিনি পার্টির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, দিঘলিয়া, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা ও সাতক্ষীরা জেলার তালা থানায় এ বাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। মজিদ বাহিনী ডুমুরিয়ায় ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ। এ বাহিনীর যোদ্ধারা স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। বাহিনীর সব অস্ত্র ও গোলা-বারুদ স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়েছিল। পুলিশ ফাঁড়ি দখল, বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ কেড়ে নেয়া এবং রাজাকারদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার মাধ্যমে এ বাহিনীর অস্ত্রের মজুদ গড়ে ওঠে। ডুমুরিয়া থানার শোভনা গ্রামে বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল। মজিদ বাহিনীর অধিকাংশ যোদ্ধা ছিলেন খুলনা জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষক, মজুর ও ছাত্র। ইপিআর ও সেনাবাহিনীর কয়েকজন বাঙালি সদস্যও অস্ত্রসহ মজিদ বাহিনীতে যোগ দেন। এছাড়া কমান্ডার আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি সশস্ত্র দল এ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়।
নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলিয়ে মজিদ বাহিনীতে শতাধিক যোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- বটিয়াঘাটা থানার হায়দার আলী জমাদ্দার ও কালু সাহা; ফুলতলা থানার লিচু, ছাকু, রফি, হাফিজ ভূঁইয়া ও আবদুল আজিজ; সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার কামেল গাজী ও জীবন মুখার্জী; পাটকেলঘাটা থানার আলতাফ হোসেন, পাইকগাছা থানার আবদুর রশিদ, কবির হোসেন ও মন্টু; সাতক্ষীরার রফিক উদ্দিন ও সাইফুল্লাহ লস্কর; ডুমুরিয়ার ফরিদ উদ্দিন, আবুল শেখ, মেহেদী লাল, নকুলেশ্বর মল্লিক, কনক বিশ্বাস, খান আলী মনসুর, অনাদী মোহন মণ্ডল ও এডভোকেট আবদুল রউফ; দৌলতপুর থানার ডা. আবদুল হালিম, কবির হোসেন, বাবলু ও প্রদীপ ভট্টাচার্য; বাগেরহাটের রণজিৎ চ্যাটার্জী, খুলনা মহিলা কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খালেদ রশিদ গুরু, ডা. মাহবুবুর রহমান, আজিজুর রহমান, এস কে বাকার, গাজী আবদুল হাকিম, আবদুল আজিজ মাস্টার প্রমুখ।
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মজিদ বাহিনীর দুটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। একটি শোভনা ইউনিয়নের গাবতলায় এবং অন্যটি ফুলতলা থানার ধামালিয়া ইউনিয়নে। মজিদ বাহিনীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয় রাজাকার বাহিনীর। মাধবকাঠি, রানাই, কোমলপুর, মিকশিমিল, রুদাঘরা, রঘুনাথপুর, চেঁচুড়ি বাজার প্রভৃতি স্থানে রাজাকারদের বিরুদ্ধে এ বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে খুলনা শহর সংলগ্ন গল্লামারী ব্রিজ রক্ষায় নিযুক্ত পাকপন্থী মুজাহিদ বাহিনীর ২১ জন সদস্য মজিদ বাহিনীর কাছে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। এছাড়া খুলনা শহরের বানিয়া খামার পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে মজিদ বাহিনী বেশকিছু অস্ত্র দখলে নেয়। এ বাহিনীর হাতে প্রায় ৪০ জন রাজাকার, ১০-১২ জন লুণ্ঠনকারী ডাকাত ও ২-৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মজিদ বাহিনীর কিছু সদস্য রাজাকারদের হাতে শহীদ হন।
ডুমুরিয়া উপজেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে মজিদ বাহিনীর সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ হয়। এ বাহিনী ডুমুরিয়া উপজেলার মুক্তিযুদ্ধে মূল ভূমিকা রাখে। ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা ডুমুরিয়ায় আসেন সেপ্টেম্বর মাসে। এর আগে এককভাবে এবং পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে মজিদ বাহিনী বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করত। মুক্তিযুদ্ধের পরে মজিদ বাহিনীর প্রধান শেখ আবদুল মজিদ দীর্ঘদিন ডুমুরিয়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৯ সালে একদল আততায়ীর হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। [দিব্যদুতি সরকার]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড