মুক্তিযুদ্ধে ভোলাহাট উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)
ভোলাহাট উপজেলা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) একটি সীমান্তবর্তী উপজেলা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে এ উপজেলা সদরের দূরত্ব ৫৬ কিলোমিটার। ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে এটি গঠিত। মুক্তিযুদ্ধে এ উপজেলার বিশেষ ভূমিকা ছিল। ভোলাহাট ভৌগোলিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের মালদহের খুব কাছে অবস্থিত বলে পাকবাহিনী এখানে কখনো স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ভোলাহাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ভোলাহাট থেকে আওয়ামী লীগ-এর মো. খালেদ আলী মিয়া এমএনএ নির্বাচিত হন। খালেদ আলী মিয়া ভোলাহাটে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষিত হওয়ার পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ভোলাহাটেও সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়৷
৭ই মার্চের পর সেনা, বিমান, নৌবাহিনী, পুলিশ এবং আইন- শৃংখলা রক্ষায় সাহায্যকারী মুজাহিদ ও আনসার বাহিনী বাংলাদেশপন্থী ও পাকিস্তানপন্থী এ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে ও বিক্ষিপ্ত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এর রেশ ধরে ভোলাহাটেও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে ভোলাহাটে আনসার কমান্ডার নেজামুদ্দিনের নেতৃত্বে সংগঠিত টহল দল জে কে পোল্লাডাঙ্গা সীমান্ত ফাঁড়িতে অপারেশন চালায়। এ অপারেশনে পাকিস্তানপন্থী ইপিআর বাহিনীর একজন হাবিলদার ও একজন কোয়ার্টার মাস্টার নিহত হয় এবং এখান থেকে পলাতক একজন ইপিআরকে গিলাবাড়ি বিওপিতে হত্যা করা হয়। এদিকে আলালপুর গ্রামের দক্ষিণে স্থাপিত ভোলাহাট স্পেশাল ক্যাম্পে একজন পাঞ্জাবি ইপিআর হাবিলদার ও দুজন সৈনিককে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা গুলি করলে তারা ঘটনাস্থলেই মারা যায় এবং চাঁনশিকারী বিওপিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত একজন সৈনিক গিলাবাড়ি বিওপিতে পালিয়ে গেলে সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়।
২৬শে মার্চ গিলাবাড়ি বিওপি কমান্ডার জেসিও শহিদুল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্থানীয় আনসার বাহিনীর সদস্য আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া, আবু বকর, সোলেমান বিশু, সৈয়দ সৈয়ম আলী, আ. রহমান, সবদের আলী, আ. সাত্তার, আইনাল হক, আ. শুকুর, সাজেদ আলী, ইউসুফ আলী, জাবেদ আলী, সান্টু প্রমুখ ভোলাহাট থানা ভবনে বৈঠক করেন। বৈঠকে পাকিস্তানি শাসনের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ
ঘোষণাসহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ভোলাহাট থানা ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী থানায় ৬-৭ জন বাঙালি ইপিআর ও ৮-১০ জন আনসার মুজাহিদকে ভোলাহাট অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য প্রস্তুত রেখে ২৭শে মার্চ ২৪-২৫ জনের একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ রওয়ানা হন। এরপর সম্মিলিত স্বাধীনতাকামী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁরা রাজশাহী গ্যারিসন আক্রমণে যুক্ত হন।
মার্চের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা সদরের বৃন্দাবন মাঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্বন্ধে সে দেশের রাজনীতিবিদরা একটি সর্বদলীয় জনসভার আয়োজন করেন। এ জনসভায় মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাবউদ্দিন পান্না বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা করেন। এ বক্তৃতার খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়। জনসভা শেষে ভারতীয় রাজনীতিবিদদের সমন্বয়ে মালদহে ‘জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১১ সদস্যবিশিষ্টি ঐ কমিটির সভাপতি হন সিপিআই দলের বিমল এমএলএ ও সেক্রেটারি হন সিপিএম-এর নেতা ইন্দ্রজিৎ।
রাজশাহী গ্যারিসন যুদ্ধে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন এ খবর প্রচারিত হলে ভোলাহাট থানায় অবস্থানকারী বাঙালি ইপিআর এবং আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর কেউ-কেউ আত্মগোপনে এবং অনেকে ভারতে আশ্রয় নেন। আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর একটি দল থানা ভবন ছেড়ে সঠিয়ার বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্যাম্প করে অবস্থান নেয়। এ-সময় থানা ভবন এবং বিওপিগুলো অরক্ষিত ছিল। এ অবস্থায় মুসলিম লীগ-এর নেতা-কর্মীরা তহশীল অফিসে (হাজী মোতাহার হোসেনের একটি কক্ষে) বৈঠক করে ৩টি বিওপি ও থানার সকল অস্ত্র তহশীল অফিসে জমা করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, সেনাবাহিনীর লোক ছাড়া অন্য কারো কাছে এসব অস্ত্র দেবে না। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে ভোলাহাট থানা মুসলিম লীগের সভাপতি মফিজ বিশ্বাস ও মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে তামিজ হাজি, গুদরা মহাজন, মঞ্জুর বিশ্বাস, আশা মণ্ডল, সাত্তার বিশ্বাস, হোসেন মোল্লাহ্, ওমসাহাক বিশ্বাস, হানিফ বিশ্বাস, সাত্তার মাস্টার, রইশ চৌধুরী, নাসির মেম্বার, ডা. মোহাম্মদ আলী, আ. মাজিদ শাহ্, মজিবর রহমান মাস্টার প্রমুখ উপস্থিত ছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা ভোলাহাট ইউনিয়ন তহশীল অফিসে একটি এসএমজি, ৮টি রাইফেল, ২৫-৩০টি হ্যান্ড গ্রেনেড ও চার থেকে পাঁচ হাজার গুলি জমা করে। যেদিন তারা তহশীল অফিসে অস্ত্র রাখে সে রাতেই মুক্তিযোদ্ধা আনসার পিসি আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া ঐ অফিসের তালা ভেঙ্গে সকল অস্ত্র নিজ বাড়িতে নিয়ে মাটিতে পুঁতে রাখেন যাতে এসব অস্ত্র শত্রুদের দখলে না যায়।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারণা এবং বাড়ি- বাড়ি গিয়ে ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে থানা ভবনে মজবুত ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা করেন। এর ফলে স্থানীয় আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর যেসব সদস্য ছড়িয়ে- ছিটিয়ে ছিলেন, তাঁরা ফিরে এসে থানায় অবস্থান নেন। এ-সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আলতাফ হোসেন ও দিনাজপুরের জজ আ. হান্নান চৌধুরী ভোলাহাটে আসেন। ১৯শে এপ্রিল চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ২১শে এপ্রিল গোমাস্তাপুর-রহনপুর পাকবাহিনীর দখলে চলে গেলে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধারা ভোলাহাটে সমবেত হন। পশ্চিমবঙ্গের পুরাতন মালদহ থানার আদমপুর ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া গোমস্তাপুর থানার মুজাহিদ বাহিনীর জেসিও ক্যাপ্টেন আলতাফ হোসেন, হাফিজুর রহমান হাসনু, কচি খান, সেরাজুল ইসলাম বুদ্ধ, মুজাহিদ বাহিনীর জেসিও জয়নাল আবেদীন, সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন, খালেদ আলী মিয়া এমএনএ, ডা. মাইনুল ইসলাম প্রমুখ ভোলাহাট থানায় এসে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এছাড়া গোমাস্তাপুর ও নাচোল থানা থেকে জয়নাল আবেদীন, নাজির হোসেন, মঞ্জুর রহমান, সোহরাব হোসেন, ভেজালু, এরশাদুল্লাহ্ মাস্টার, সামশুদ্দিন, সুলতান, আ. রাজ্জাক, সাইফুদ্দিন প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা ভোলাহাটে আসেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে আসেন রোজিউর রহমান বিশু, হাডডা, ফলতান, জয়নাল, আ. রহমান, তাজা, হাবিব, সিরাজুল ইসলাম বুলু প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে খালেদ আলী মিয়া এমএনএ, সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন, আ. খালেক বিশ্বাস, মহিউদ্দিন জুট, আতাউর রহমান আতা মাস্টার প্রমুখ প্রায়ই থানা ভবনে অবস্থান করতেন।
এভাবে ভোলাহাট থানাকে হেডকোয়ার্টার্স করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। এখান থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পরিকল্পনা তৈরি, পরামর্শ, নির্দেশনা প্রদান, ব্যবস্থাপনা, অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ, বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও নার্সিং সেবা প্রদান এবং টহল ও অপারেশন কমান্ড পরিচালিত হতো। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার হবিবপুর থানার হাজী কাঞ্চ শাহ (গ্রাম আইহো)-র বাড়িতে একটি অফিস খোলা হয়। সেখানে মুক্তিবাহিনীর ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যোগাযোগ, অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের বিষয়ে সমন্বয় করা হতো। ভোলাহাট থানা থেকে মুক্তিবাহিনীর নেতৃবৃন্দ আইহো-তে স্থাপিত অফিস, মালদহ ডাকাবাংলো ও মালদহ রাজ হোটেল এবং ৩ নম্বর সাব-সেক্টর মহদীপুরস্থ গৌড়বাগানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। এভাবে দ্রুত গৃহীত ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মহদীপুর সাব-সেক্টর ও এর অধীনস্থ ভোলাহাট- গোমস্তাপুর থানায় যুদ্ধ পরিচালিত হতো।
ভোলাহাটে প্রথমত আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী এবং ইপিআর-এর সদস্যরা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এরপর এলাকার ছাত্র-যুবকরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। যুবকদের অনেকে গিলাবাড়ি, ভারতের মালদহের আদমপুর, গৌড়বাগান এবং দেরাদুন, দার্জিলিং ও অন্যান্য স্থানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। গিলাবাড়ি ইপিআর ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের হাল্কা প্রশিক্ষণ, পিটি-প্যারেড ও দিকনির্দেশনামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এখানে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের নার্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া গিলাবাড়ি বিত্তপি-র বিপরীতে ভারতের আদমপুর বিএসএফ ক্যাম্পের আওতায় মহানন্দা নদীর তীরে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ শিবির ছিল।
ভোলাহাটে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডাররা ছিলেন- নেজামুদ্দিন, সৈয়দ আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া, সাজেদ আলী, সানাউল্লাহ্, আরজেদ আলী ও ওবায়দুল মুক্তার।
ভোলাহাট থানা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। পাকবাহিনী ভোলাহাটে অনুপ্রবেশ করে সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিহত করা হয়। ফলে অনেকবার মুক্তিযোদ্ধাদের পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়।
পাকবাহিনী ৩১শে মে প্রথম ভোলাহাটের বালুটুঙ্গী গ্রামে অনুপ্রবেশ করে। এদিন তারা মুসলিম লীগ নেতা সহিমুদ্দিন বিশ্বাসের বাড়িতে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। ১৪ই জুন তারা বটতলা আসে। ২রা জুলাই তারা ভোলাহাটের মুশুরীভুজায় আসে। এরপর তারা তাদের রহনপুর ঘাঁটিতে ফিরে যায়। পাকবাহিনী এ দুবার মুক্তিবাহিনীর কোনো প্রতিরোধ ছাড়া ভোলাহাট ঘাঁটিতে ফিরে যায়। অন্যান্য সময় তাদের প্রতিরোধের মুখে ফিরে যেতে হয়েছে। পাকবাহিনী ভোলাহাটে স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের কোনো সুযোগ পায়নি। ভোলাহাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ নেতারা পাকবাহিনীকে সহায়তার জন্য রহনপুরে পাকসেনা ঘাঁটি ও বোয়ালিয়ায় রাজাকার ক্যাম্পে আশ্রয় গ্রহণ করে। মুসলিম লীগের এসব নেতার মধ্যে ছিল- সহিমুদ্দিন বিশ্বাস (বালুটুঙ্গী), মুশা মিয়া (খড়কপুর), আ. কুদ্দুশ মেম্বার (ময়ামারী), মফিজ বিশ্বাস (হোসেনভিটা), মঞ্জুর বিশ্বাস, আ. সাত্তার বিশ্বাস (ধনিয়াপাড়া), হানিফ বিশ্বাস (কুমিরজান), ডা. মোহাম্মদ আলী (তেলিপাড়া), আ. মাজিদ শাহ্ (কানারহাট), মজিবর রহমান মাস্টার (গোহালবাড়ী, গোহালবাড়ী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান) এবং আ. রশিদ মাস্টার (ময়ামারী)। স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে যারা রহনপুর ও বোয়ালিয়ায় মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তারা হলো-ইলিয়াস (বারই পাড়া), ইশ মোহাম্মদ ও শিষ মোহাম্মদ (দলদলী), মন্তাজ আলী ঘাটু (ঘাইবাড়ি), আ. মাতিন মাস্টার (বীরেশ্বরপুর), আবু তালেব (বীরেশ্বরপুর), আ. খালেক (বীরেশ্বরপুর), ইদ্রিশ (মুশুরীভুজা), আ. খালেক (নামো মুশুরীভূজা), ইয়াসিন আলী (মুশুরীভুজা) প্রমুখ)।
২রা আগস্ট মুশুরীভুজা ক্যানেল যুদ্ধএ পাকবাহিনী প্রচণ্ড মার খেয়ে তাদের সৈনিকদের লাশ নিয়ে রহনপুরে যাবার পথে কাঞ্চনতলা গ্রামে কালু (পিতা লাল মহম্মদ, কাঞ্চনতলা)-কে হত্যা করে। এছাড়া একই গ্রামের সোহরাব হোসেন ও এসাহাক আলী (উভয়ের পিতা ঝড়ু মণ্ডল), হাসিমুদ্দিন (পিতা জাফর আলী), ফেনেস আলী (পিতা ইঁদু মোল্লা), সলেমান মণ্ডল (পিতা ফজর মণ্ডল) এবং ছোট বঙ্গেশ্বরপুরের একরাম মাস্টার (পিতা লাল মহাম্মদ) প্রমুখকে ধরে নিয়ে যায়। রহনপুরের ঘাঁটিতে নিয়ে পাকসেনারা সোহরাব, এসাহাক ও হাসিমুদ্দিনকে নদীর ধারে গুলি করলে সোহরাব ও হাসিমুদ্দিন মারা যান। এসাহাক প্রাণে বেঁচে গেলেও মারাত্মকভাবে আহত হন। অপর ৩ জনের ওপর হানাদাররা ৭-৮ দিন ধরে অমানবিক নির্যাতন চালায়।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা ৯ই নভেম্বর ভোলাহাটের বড় জামবাড়িয়া গ্রামে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। তারা লাইনে দাঁড় করিয়ে গ্রামের ১১ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। এটি বড় জামবাড়িয়া গণহত্যা নামে পরিচিত।
পাকবাহিনীর ফেলে দেয়া মাইন বিস্ফোরণে আকবর আলী (পিতা ফিরোজ আলী), তাসুরুদ্দিন (পিতা আ. আজিজ) এবং এন্তাজ আলী (পিতা উমুরুদ্দিন) আহত হন। ভোলাহাটের বড়জামবাড়িয়া গ্রামে একটি গণকবর রয়েছে। এখানে নিহত ১১ জন গ্রামবাসীকে কবর দেয়া হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার্স ভোলাহাট থানা কার্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব, টহল, অপারেশন, নেতৃত্ব ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত বৈঠক হতো। মুক্তিবাহিনীর মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করতেন হাফিজুর রহমান। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথমত ৪টি দলে ভাগ করা হয়েছিল। ৪ দলের সেকশন কমান্ডার ছিলেন আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া, তুরফান, সাজেদ আলী ও সাইফুদ্দিন। মুক্তিবাহিনী ঘাইবাড়ি থেকে আলমপুর পর্যন্ত টহল দিয়ে থানা ভবনে ফিরে আসত। প্রথম পর্যায়ে মহদীপুর সাব-সেক্টর দফতর থেকে ভোলাহাট কমান্ডকে ১৩টি অস্ত্র দেয়া হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে ছিল ৪টি মার্ক-৪ (এমএফ-৪), ৪টি ৩০৩ রাইফেল, ২টি স্টেনগান এবং ৩ জন ইপিআর-এর কাছে থাকা ৩টি রাইফেল। তবে পূর্ব থেকে ভোলাহাট কমান্ডের কাছে স্থানীয় ব্যক্তিদের নিকট থেকে সংগৃহীত ৯টি সিঙ্গেল ও ডবল ব্যারেল সিভিল গান ছিল। এভাবে ভোলাহাট থানা ভবন হেডকোয়ার্টার্স থেকে মুক্তিবাহিনীর টহল ও বিভিন্ন সময়ে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি চলে ও যুদ্ধ হয়।
ভোলাহাট থানার পঞ্চনন্দপুর গ্রামের পশ্চিমে ১১ই জুলাই মুক্তিবাহিনীর টহল দলের সঙ্গে পাকবাহিনীর তীব্র যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর ফাইটিং পেট্রোল পার্টি সাজেদ আলীর নেতৃত্বে থানা থেকে বের হয়ে পঞ্চনন্দপুর গ্রামে পৌঁছলে পাকবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধে। এতে মুক্তিযোদ্ধা সুলতান গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন (তাঁর বাড়ি গোমস্তাপুর থানার বেগুনবাড়ি গ্রামে; শত্রুবাহিনী তাঁর লাশ নিয়ে যায়)। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দলে ছিলেন সাজেদ আলী (কমান্ডার), সুলতান, সাইফুদ্দিন, ওয়াশিল মোল্লা, তাজা শেখ, তুরফান প্রমুখ। রেকিতে ছিলেন মুনসুর (পুলিশ সদস্য) ও মুখলেশ। মুক্তিবাহিনীর কাছে পাঁচটি এমএমআর-৪ রাইফেল ও ২টি স্টেনগান ছিল। অপরদিকে মেজর সাজ্জাদের নেতৃত্বে ১৮ জন সৈনিকের পাকবাহিনীর দলে এলএমজি, এসএমজি, স্টেনগান-সহ ভারী অস্ত্র ছিল। এ-যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী তাদের রহনপুর ঘাঁটিতে ফিরে যায়। যুদ্ধে পরাজিত পাকবাহিনী এ অঞ্চলে আর প্রবেশ করতে সাহস করেনি।
১৪ই জুলাই ভোলাহাট থানা ভবন থেকে বাহাদুরগঞ্জ গ্রামের শহীদ ও মানোয়ার হোসেন মনা নামে দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে রেকিতে পাঠিয়ে মুক্তিবাহিনীর ১৮ সদস্যের ফাইটিং পেট্রোল পার্টি বের হয়। এ দলের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন তুরফান এবং পেট্রোল কমান্ডার ছিলেন আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া। মুক্তিবাহিনীর কাছে এলএমজি, ১টি রাইফেল, কিছু ৩০৩ রাইফেল এবং ১টি দুই ইঞ্চি মর্টার ছিল। পাকবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা মুশুরীভুজা ক্যানেলে অবস্থান গ্রহণ করেন। পাকবাহিনী ক্যানেলের কাছাকাছি আসার পরপর তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে রসদ ফুরিয়ে এলে মুক্তিবাহিনী অবস্থান পরিবর্তন করে। অন্যদিকে পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পেছনে ফিরে যায়।
পাকবাহিনীর ভোলাহাট থানা আক্রমণের খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনীর অপর একটি ফাইটিং পেট্রোল পার্টি ইপিআর সদস্য খলিলের নেতৃত্বে ১৯শে জুলাই টহলে বের হয়। এ দলে সহযোগী কমান্ডার ছিলেন আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া। রেকিতে ছিলেন মতি মাইছা। মুক্তিবাহিনী মুশুরীভুজা ক্যানেলে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকবাহিনী মুশুরীভুজা ইউসুফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। তাদের সঙ্গে রাজাকারদের মধ্যে মুশা মিয়া, সহিমুদ্দিন বিশ্বাস, মফিজ বিশ্বাস, তাজাম্মল হকসহ আরো অনেকে ছিল। মুক্তিবাহিনী ইউসুফ আলী স্কুলের সামনে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ওপর আক্রমণ করে। প্রথমে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সেনাবাহিনীর আর্টিলারির মান্নান দুই ইঞ্চি মর্টারের ৩ রাউন্ড গোলা নিক্ষেপ করেন। এরপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। রাত ১২টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এ-যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। যুদ্ধের পর পাকবাহিনী সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়।
২৬শে জুলাই সুবেদার গফুর মণ্ডলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর ১৬-১৭ জনের একটি ফাইটিং পেট্রোল পার্টির সঙ্গে দুর্গাপুর-কাশিয়াবাড়ি ক্যানেলে পাকবাহিনীর মেজর ইউনুসের নেতৃত্বাধীন শত্রুপক্ষের যুদ্ধ হয়। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এ-যুদ্ধ চলে। এতে মুক্তিবাহিনীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পাকবাহিনীর দুজন সৈনিক গুরুতর আহত হয় এবং তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
আগের দিনের যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর অপর একটি দল দুর্গাপুর-কাশিয়াবাড়ি ক্যানেলে ২৭শে জুলাই সকাল ৭টা পর্যন্ত ডিফেন্স নিয়ে ওঁৎ পেতে অবস্থান করে। পাকবাহিনী বা রাজাকারদের কোনো দল না আসায় পরে মুক্তিযোদ্ধা দল থানা ভবনে ফিরে আসে।
গোমস্তাপুর থানার কাশিয়াবাড়ির মুক্তিযোদ্ধা কাশেমের মাধ্যমে ভোলাহাট থানা আক্রান্তের খবর পেয়ে ২রা আগস্ট মুক্তিবাহিনীর ২০-২৫ জনের একটি ফাইটিং পেট্রোল পার্টি বের হয়। এ দলের কমান্ডার ছিলেন ইপিআর সদস্য ওয়শিল মোল্লা এবং সহকারী কমান্ডার ছিলেন আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া ও মুক্তিযোদ্ধা আতাউর (শিবগঞ্জ)। মুক্তিবাহিনী বেলা ১টার দিকে মুশুরীভুজা ক্যানেলে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। দুপক্ষের মধ্যে ১ ঘণ্টা প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ফলে পাকবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মুশুরীভুজা ক্যানেল যুদ্ধএ পাকবাহিনীর ৪০ জন সেনা সদস্য নিহত হয়।
এরপর ভোলাহাট থানা কার্যালয় ক্যাম্প থেকে ক্যাপ্টেন আলতাফের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা মুশুরীভূজায় মুক্তিবাহিনীর পূর্ববর্তী দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে পুনরায় মুশুরীভুজা ক্যানেল বরাবর ডিফেন্স স্থাপন করে। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধা আ. শুকুরকে রেকিতে পাঠানো হয়। তাঁর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মুক্তিবাহিনী এখান থেকে ডিফেন্স তুলে নিয়ে কাশিয়াবাড়িতে বোয়ালিয়া কাউন্সিল ভবনে স্থাপিত রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ আক্রমণে রাজাকার কমান্ডার ও মুজাহিদ বাহিনীর জেসিও আ. খালেক নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা আলমপুর থেকে পাকবাহিনীর সোর্স আ. রশিদকে ধরে ভোলাহাট থানায় নিয়ে আসেন। মুক্তিবাহিনী কাশিয়াবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প থেকে একটি স্টেনগান, একটি রাইফেল, একটি সিভিল গান, দুই বাক্স গুলি, একটি রেডিও সেট ও একটি টেলিফোন সেট জব্দ করে। এ-সময় পাকবাহিনী তাদের রহনপুর ক্যাম্প থেকে পরপর ৬টি শেল নিক্ষেপ করে। তবে এসব শেল লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিলে গিয়ে পড়ে।
৩রা আগস্ট সকালে মুক্তিবাহিনী ভোলাহাট থানার দিকে পাকবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে মুজাহিদ বাহিনীর জেসিও আলতাফের নেতৃত্বে একটি ফাইটিং পেট্রোল পার্টি বের করে। এ দল ঘাইবাড়ির একটি আমবাগানে অবস্থান নিয়ে মহানন্দা নদীর কাছ থেকে বিল পর্যন্ত ডিফেন্স স্থাপন করে। স্থানীয় বাসিন্দা আইনাল হাজি মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবারহ করেন। এক সময় এখান থেকে সরে এসে মুক্তিবাহিনী দুর্গাপুর-কাশিয়াবাড়ি ক্যানেল বরাবর বিল পর্যন্ত ডিফেন্স স্থাপন করে। দুর্গাপুর গ্রামের নেজামুদ্দিন মণ্ডল তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতির খবর পেয়ে দখলদার পাকবাহিনী সেদিন আর অগ্রসর হয়নি। ফলে মুক্তিবাহিনী ভোলাহাট থানা ক্যাম্পে ফিরে আসে। ৪ঠা আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে পাকবাহিনী সকাল ৮টার দিকে রহনপুর থেকে প্রচুর শেল নিক্ষেপ করে। এরপর ২৫০-৩০০ পাকিস্তানি সৈন্য ও প্রায় ৭০ জন রাজাকারদালালের একটি দল ভোলাহাটের দিকে অগ্রসর হয়ে মুশুরীভুজার হিন্দু স্বর্ণকারের বাড়ি পর্যন্ত আসে।
এখান থেকে তারা ভারতের আশরাফপুর বিএসএফ ক্যাম্প লক্ষ করে বেশকিছু মর্টার শেল নিক্ষেপ করে। ফেরার সময় তারা নেজামুদ্দিন মণ্ডলকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে রহনপুরে নির্মমভাবে হত্যা করে। নেজামুদ্দিন মণ্ডল (দুর্গাপুর, গোমস্তাপুর) শহীদ হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে। ৫ই আগস্ট মুক্তিবাহিনীর একটি দল ঘাইবাড়ি ঈদগাহ্ ময়দানে ডিফেন্স স্থাপন করে। অন্য একটি দল দুার্গপুর-কাশিয়াবাড়ি ক্যানেল বরাবর ডিফেন্স নেয়। এ ডিফেন্স থেকে ফাইটিং পেট্রোল পার্টির একটি শক্তিশালী দল বোয়ালিয়া ইউনিয়নের কালুপুর আমবাগানে অস্থায়ী ডিফেন্স স্থাপন করে। কাশিয়াবাড়ি ডিফেন্সে সীমিতসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে কভারিং দেয়ার জন্য রাখা হয়। অন্য দল ঘাইবাড়ি ঈদগাহ্ ময়দানের অবস্থান থেকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য সতর্ক অবস্থায় প্রস্তুত থাকে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও শক্তিশালী ডিফেন্স তৈরি হয়। কিন্তু পাকহানাদার বাহিনী অগ্রসর না হওয়ায় কোনো যুদ্ধ হয়নি।
১০ই আগস্ট মহানন্দা নদীর মকরমপুর ঘাটের কাছে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একটি যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে পাকসেনা, রাজাকার, আলবদরসহ শত্রুপক্ষের ৫-৬ শত সদস্য ছিল। এখানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সম্মুখ যুদ্ধে ৭১ জন আর কাশিয়াবাড়িতে ডিফেন্সে কভারিং দেয়ার জন্য ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুত ছিলেন। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার ছিলেন গফুর মণ্ডল। অন্য কমান্ডাদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন কুতুবউদ্দিন, সুবেদার কফিলউদ্দিন, সুবেদার মীর মোকাদ্দেশ, আনসার এডজুট্যান্ট গোলাম মোস্তফা, আনসার পিসি সৈয়দ আ. রাজ্জাক রাজা মিয়া প্রমুখ এবং আর্টিলারির দায়িত্বে ছিলেন আ. মান্নান। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে শত্রুপক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়। মকরমপুর ঘাট যুদ্ধএ পাকবাহিনীর ৯-১০ জন সৈন্য হতাহত হয়। এ-যুদ্ধে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফ-এর একটি কোম্পানি মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন দেয়ার জন্য মুশুরীভুজা ইউসুফ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে অবস্থান নেয়। বিএসএফ-এর কমান্ডিং অফিসারদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন চতুর্বেদী, ক্যাপ্টেন বিক্রম রায় বাহাদুর প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও রাজাকাররা বড় জামবাড়িয়া গ্রামে ৯ই নভেম্বর যে হত্যাকাণ্ড চালায়, তার খবর পেয়ে ঐদিন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মহদীপুর থেকে ৮১ এম এম মর্টার প্লাটুনের একটি চৌকশ দলসহ ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ছোট জামবাড়িয়া গ্রামে আসেন। তিনি পিছুহটা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে বড় জামবাড়িয়া ও গোমস্তাপুরের ৪টি গ্রাম শত্রুবাহিনীর কবলমুক্ত করেন। এ-যুদ্ধে ২ জন পাকসেনা নিহত হয়। এখানকার যুদ্ধের পর ছোট জামবাড়িয়ার আনেশ উদ্দিনের এবং বড় জামবাড়িয়ার আ. কুদ্দুসের বাড়িতে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এ এলাকায় মুক্তিবাহিনীর প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন শওকাত আলী (চৌঢালা-বেণিচক)। মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধ ও দুঃসাহসী রণ-প্রস্তুতির কারণে দখলদার বাহিনী ভোলাহাটে তৎপরতা চালাতে পারেনি। ভোলাহাট সব সময় মুক্ত অঞ্চল ছিল। এ উপজেলার কোনো এলাকা পাকবাহিনী দখলে নিতে পারেনি।
ভোলারহাটের শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন— জিন্নাত হোসেন (পিতা ঝড়ু সেখ, বাহদুরগঞ্জ; ৩০শে সেপ্টেম্বর গোমস্তাপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের ঠাকুরের আমবাগান যুদ্ধে শহীদ; পাকবাহিনী তাঁর লাশ নিয়ে যায়), খবিরউদ্দিন জিন্নাহ (পিতা পাতানু মহাজন, তাঁতিপাড়া; ২৭শে আগস্ট শুক্রবার মালদহের আদমপুর প্রশিক্ষণ শিবির থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ভোলাহাটে ফিরে আসার পথে মহানন্দা নদীতে নৌকা ডুবে মৃত্যু) এবং কামালউদ্দিন হেনা (পিতা আ. জব্বার, ভোলাহাট; ৬ই অক্টোবর গোমস্তাপুর উপজেলার শ্যামপুর যুদ্ধে শহীদ)।
ভোলাহাট উপজেলা চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের একটি স্মৃতিসৌধ রয়েছে। তাছাড়া শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সুলতানের স্মরণে পঞ্চনন্দপুর গ্রামের পশ্চিমে তাঁর শহীদ হওয়ার স্থানে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কামালউদ্দিন হেনার নামে ভোলাহাট সাঠিয়ার বাজার-ইমামনগর সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। [মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড