বীর বিক্রম মইনুল হোসেন চৌধুরী
মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম (১৯৪৩-২০১০) বীর মুক্তিযোদ্ধা, ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার ও পরবর্তীতে এর অধিনায়ক। ১৯৪৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার শিওরখাল গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতার নাম নুরুল হোসেন চৌধুরী এবং মাতা রিজিয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি ১৯৬২ সালে কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৬৪ সালে নিয়মিত কমিশন লাভ
করেন। তাঁকে পদাতিক ব্যাটালিয়নে নিয়োজিত করা হয়। ১৯৬৫ সালে তিনি পাক-ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ঢাকার অদূরবর্তী জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ পাকিস্তানকে এক জটিল রাজনৈতিক আবর্তে নিক্ষেপ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচনের এ ফলাফলের জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। নির্বাচনের পরপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হীন উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার জনগণকে সতর্ক করে দেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে জনগণের পাশাপাশি বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাগণও সংকটকালে করণীয় সম্বন্ধে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা লাভ করেন। এ-সময় মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী জয়দেবপুর সেনানীবাসে তাঁর কমান্ডিং অফিসার মেজর কে এম সফিউল্লা, বীর উত্তম-এর সঙ্গে পরামর্শ করে সতর্ক অবস্থান নেন। তাঁরা বুঝতে পারেন চূড়ান্ত মুহূর্ত অত্যাসন্ন। তাই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তাঁরা গোপনে প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সমগ্র পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯শে মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জাহানজেব আরবাব একদল রক্ষিসহ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাজেন্দ্রপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। পথে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় বিক্ষুব্ধ জনতা ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এর মধ্য থেকে তাকে রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসার জন্য মেজর মইনুল হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া দেয়া হয়। ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়ে ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর এক পর্যায়ে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেয়, কিন্তু মেজর মইনুল সুকৌশলে তা এড়িয়ে যান। এরপর ব্রিগেডিয়ার আরবাবের সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে হরমুজসহ বেশ কয়েকজন মানুষ ঘটনাস্থলে হতাহত হয়। এ ঘটনা সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এর দ্বারা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কঠোর অবস্থান গ্রহণের কথা সহজেই বোঝা যায়। অতঃপর ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে গণহত্যায় লিপ্ত হয়। এমনি অবস্থায় ২৮শে মার্চ মেজর কে এম সফিউল্লাহর সঙ্গে একাত্ম হয়ে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদ্রোহ করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা জয়দেবপুর মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরি ও রাজেন্দ্রপুর এমুনিশন ডিপো থেকে সকল অস্ত্র, ভারী কামান, গোলাবারুদ, রসদ, সামরিক যানবাহন প্রভৃতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। ২৮শে মার্চ দিনের মধ্যভাগে মেজর কে এম সফিউল্লাহ রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল সৈন্য নিয়ে ময়মনসিংহের দিকে চলে যান। একইদিন রাতে বাকি সৈন্যদের নিয়ে মেজর মইনুল ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ময়মনসিংহে গিয়ে মেজর সফিউল্লাহর সঙ্গে যোগ দেন। ৪ঠা ও ১০ই এপ্রিল বিদ্রোহী সেনানায়কদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় সভা হবিগঞ্জের সীমান্তবর্তী তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত হয়। মেজর মইনুল হোসেন এ সভায় কর্নেল এম এ জি ওসমানী -, মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম, মেজর শাফায়াত জামিল, বীর উত্তম, মেজর জেনারেল আবদুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম-, মেজর কে এম সফিউল্লাহ প্রমুখ বাঙালি সেনা অফিসারদের সঙ্গে যোগ দেন। মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে মেজর মইনুল হোসেন ৩নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। অক্টোবরে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ‘এস’ ফোর্স নামে পৃথক ব্রিগেড গঠিত হলে, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। পাকসেনাদের বিরুদ্ধে এম্বুশ, রেইড, গেরিলাযুদ্ধ ও সম্মুখ সমরে তিনি অসীম সাহস, দক্ষতা ও কৌশলের স্বাক্ষর রাখেন।
১১শ বেঙ্গলের সঙ্গে সমন্বিতভাবে তাঁর ২য় বেঙ্গল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিস্তীর্ণ এলাকা তিনি মুক্ত করতে সমর্থ হন। ১লা ও ২রা ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর আখাউড়াতে এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এতে ‘এস’ ফোর্স কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১১শ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়োজিত করেন। তাঁদের পেছনে ছিল ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর দূরপাল্লার ভারী কামানের কভারেজ। যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর পরাজয় ঘটে। আখাউড়া মুক্ত হবার পর মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ দখলে নেয়। এরপর মইনুল হোসেনের কমান্ডে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সৈন্যরা নরসিংদী মুক্ত করতে এগিয়ে যান। ১২ই ডিসেম্বর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রায়পুরায় পৌছে যায়। মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে একদল সৈন্য ভুলতা, মুড়াপাড়া, রূপগঞ্জ হয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। ১৪ই ডিসেম্বর মেজর মইনুল হোসেন তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী, কে এম সফিউল্লাহর বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সেনাসদস্যদের সঙ্গে ঢাকার নিকটকর্তী ডেমরা শিল্প অঞ্চলে এসে পৌঁছেন। ডেমরায়ও পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের গোলা বিনিময় হয়। ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ২টা পর্যন্ত পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। একইদিন পাকহানাদার বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে সম্মতি ও বিকেল ৪টায় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়।
রাজেন্দ্রপুরের সেনাবিদ্রোহ থেকে শুরু করে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক হিসেবে মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম সাহস ও নেতৃত্বের দক্ষতার সঙ্গে যে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তার স্বীকৃতিস্বরূপ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
স্বাধীনতার পর মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী সেনাবাহিনীতে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। তিনি প্রথমে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব, এরপর ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেড ও লগ এরিয়ার অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের শেষদিকে তাঁকে প্রেষণে লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে জাতীয় নিরাপত্তা দপ্তরে কাউন্সিলর করা হয়। ১৯৭৭ সালে তাঁকে সেনাবাহিনীর এডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭৮ সালে ব্রিগেডিয়ার এবং ১৯৮০ সালে তিনি মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি পান। ১৯৮২ সালে তাঁকে প্রেষণে ফিলিপাইনে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ করা হয়। পরে তিনি যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তিনি অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১০ সালের ১০ই অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম রুবী চৌধুরী। তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ ও শেখ সাইয়েদুল ইসলাম]
তথ্যসূত্রঃ মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব.) বীর বিক্রম, একজন জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা ২০১৮
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড