মুক্তিযুদ্ধে মং রাজা মং প্রু সেইন
মং প্রু সেইন, মং রাজা (১৯১০-১৯৮৪) পার্বত্য চট্টগ্রামের মং সার্কেলের রাজা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সংগঠক, প্রশিক্ষক ও প্রত্যক্ষ যোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯১০ সালের ১০ই নভেম্বর তিনি মানিকছড়ির রাজবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কোং হ্লা এবং মাতার নাম রাজকুমারী নানুমা দেবী। মং প্রু লেখাপড়া করেন কলকাতার রিপন কলেজিয়েট স্কুল ও চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে। আইনবিদ্যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্ৰথম স্নাতক। ইংরেজ শাসনামলে কুতুবদিয়া দ্বীপাঞ্চলে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩২ সালে বিয়ে করেন চাকমা রাজকুমারী নিহার দেবীকে। ১৯৫৪ সালে মং সার্কেলের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৬৮-৬৯ সাল থেকে মং প্রু সেইন স্বাধীকার আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি পার্বত্যাঞ্চলের জনগণকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চৌকস স্যুটার মং প্রু সেইন দক্ষতার সঙ্গে প্রতিরোধযোদ্ধাদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দেন। মাতৃভূমিকে রক্ষার লড়াইয়ে ব্যবহারের জন্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং প্রতিরোধযোদ্ধাদের তিনি নিজের ৩৩টি আগ্নেয়াস্ত্র, ব্যক্তিগত গাড়ি ও কয়েকটি জিপ প্রদান করেন। রাজবাড়ির নানুমা দেবী হলটিতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে আহত প্রতিরোধযোদ্ধা এবং নির্যাতিত মেয়েদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। রাণী নিহার দেবী পার্বত্য নারীদের নিয়ে এই সেবা কাজে অংশগ্রহণ করেন। সীমান্ত অভিমুখী বাঙালি ও পার্বত্য নৃ-গোষ্ঠীর অসহায় মানুষদের জন্য মানিকছড়ির রাজবাড়িটি হয়ে উঠেছিল একটি বিশাল আশ্রয় কেন্দ্র। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ সপ্তাহব্যাপী রাজবাড়ীতে আশ্রিত মানুষদের জন্য রাজা মপ্রু সেইন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন।
১লা মে মানিকছড়ি পতনের পর সীমান্ত অতিক্রম করে মং প্রু ত্রিপুরার হরিণা ক্যাম্পে চলে যান। মুক্তিবাহিনীর সদস্য নিয়োগ, সামরিক প্রশিক্ষণ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা অপারেশন চালানোয় তিনি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকের … ভূমিকা পালন করেন। রূপাইছড়ি ও হরিণা ক্যাম্পে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা থেকে আগত সাংবাদিক ও প্রতিনিধি দলের কাছে বহুবার তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা, নিপীড়ন ও নারীনির্যাতন এবং মুক্তিবাহিনীর প্রতিরোধের বিবরণ তুলে ধরেন। তাঁদের দেয়া সাক্ষাৎকারে মং প্রু সেইন বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী-র সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন। মং রাজার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সংবাদটি বিশ্ব গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়। তাঁর সাক্ষাৎকারগুলো বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অনুকূলে জনমত সৃষ্টিতে অবদান রাখে।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মং প্রু সেইনকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে মিজো বাহিনী-কে কাজে লাগাতে পারে এ আশঙ্কায় ভারতীয় বিএসএফ মং রাজার নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়। আগরতলায় অবস্থানকালীন সময়ে তিনি ভারতীয় মিত্রবাহিনী – এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিবাহিনীর অফিসাররা তাঁকে অনারারী কর্নেল হিসেবে সম্মান জানাতেন। নভেম্বরের শেষদিকে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মং প্রু সেইন আখাউড়া আক্রমণে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। আখাউড়া পতনের পর মং প্রু সেইন মিত্রবাহিনীর ইউনিটের সঙ্গে ১৭ই ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মং প্রুর মানিকছড়ির রাজবাড়িটি দখল করে আঞ্চলিক সেনা সদর দপ্তর স্থাপন করে এবং লুটপাটের পাশাপাশি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসংখ্য সেগুন গাছ, মার্সিডিজ, ফোর্ড, ভক্সওয়াগান গাড়ি ও ১টি উইলি জিপ, স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি, ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানার বিভিন্ন প্রাণী ও দুষ্প্রাপ্য পাখি, হাতি, ঘোড়া ও গবাদি পশু, ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, ৩৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, দু-তিনশ বছরের পুরনো বাদ্যযন্ত্র ও এ্যান্টিক সামগ্রী, দামি আসবাবপত্র ইত্যাদি অনেক মূল্যবান সম্পদ হারান। তিনি বলতেন, ‘মাতৃভূমির স্বাধীনতার চেয়ে আমার রাজত্ব, রাজ্য বা রাজভাণ্ডারের মূল্য কোনো অংশেই বেশি নয়’। রাজা মং প্রু সেইন স্বাধীনতাযুদ্ধে যে অবদান রাখেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে আছে। ১৯৮৪ সালে তিনি পরলোক গমন করেন। [মেসবাহ কামাল, জান্নাত-এ-ফেরদৌসী]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড