You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভৈরব নদের পাড় বধ্যভূমি (অভয়নগর, যশোর)

রাজাকার, আলবদর ও শান্তি কমিটির সদস্যরা অভয়নগরের ওয়াপদা ভবনে ভৈরব নদের পাড়ে নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির স্থাপন করে অসংখ্য মানুষকে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে লাশ নদে ফেলে দিত। দড়ি দিয়ে পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় প্রতিদিন অনেক লাশ ভৈরব নদ দিয়ে ভেসে যেত।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে যশোরের অভয়নগর উপজেলায় খাজা আব্দুল সাঈদ শাহর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি, কবির মোড়ল ও ছবদুল হোসেনের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী এবং কবির হোসেনের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী গঠিত হয়। অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত ওয়াপদা ভবন ছিল রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্র। অভয়নগর এবং আশপাশের উপজেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোকদের ধরে এনে এখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো। এরপর তাঁদের চোখ বেঁধে ভৈরব নদের পাড়ে নিয়ে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হতো। মাঝে-মাঝে পাকসেনারা এ বন্দিশিবির ও নির্যাতনকেন্দ্রে আসত। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এখানে ধরে এনে হত্যা করা হতো বলে নিহতদের অনেকের পরিচয় জানা যায়নি।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে এক শুক্রবার উপজেলার নওয়াপাড়া পীরবাড়ি মসজিদের সামনে থেকে আব্দুল কুদ্দুস খাঁ (বুনো রামনগর), আব্দুল খালেক খান ও সাদেক আলীকে রাজাকার কবির মোড়ল ও তার সহযোগীরা আটক করে। তারা আব্দুল কুদ্দুস খাঁকে ভৈরব নদের তীরে ওয়াপদা ভবনে নিয়ে যায়। সেখানে ছিল শ্রীধরপুরের রাজাকার মকবুল হোসেন। ওয়াপদা ভবনে নিয়ে তাকে আলাদা একটি ঘরে রাখা হয়। একই ঘরে আগে থেকে দুজনকে এনে রাখা হয়েছিল। তাদের একজন ছিল ২১-২২ বছরের একটি মেয়ে। তার বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায়। তার ওপর রাজাকাররা পাশবিক নির্যাতন চালাত। অপরজনের বাড়ি অভয়নগর উপজেলার কোদলা গ্রামে। রাজাকাররা আব্দুল কুদ্দুস খাঁ-র ওপর লোহার রড ও লাঠি দিয়ে এমনভাবে পেটায় যে তার বুকের হাড় ভেঙ্গে যায়। বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে আনা মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের নদের পাড়ে দাঁড় করিয়ে জবাই ও গুলি করে হত্যা করার পর লাশ নদে ভাসিয়ে দেয়া হতো। দড়ি দিয়ে পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় প্রতিদিন বহ লাশ ভৈরব নদ দিয়ে ভেসে যেত। জল্লাদ নামে পরিচিত কুখ্যাত রাজাকার মান্না মৌলভী নিজে নদের পাড়ে জবাই করে লাশ পানিতে ভাসিয়ে দিত। রাজাকাররা উপজেলার কোদলা গ্রামের শামসুর রহমান, হরমুজ আলী এবং ইসহাক আলীকে ওয়াপদা ভবনে ধরে নিয়ে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে ভৈরব নদে ভাসিয়ে দেয়।
১৫ই সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় উপজেলার পাথালিয়ার আব্দুল মান্নান, আড়পাড়ার মোমেন মজুমদার, সমশপুরের আব্দুর রাজ্জাক, বুইকরার শফিকুল ইসলাম, বারান্দীর মোদাচ্ছের মোল্যা, হাসেম মোল্যা, হামিদ মোল্যা, কাদের মোল্যা এবং আব্বাস বিশ্বাসের নেতৃত্বে ১০-১৫ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করায় আতাউর রহমান বিশ্বাস (বারান্দী) ও তার পিতা ইমান আলী বিশ্বাসকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের প্রথমে নওয়াপাড়া বাজারে আমজাদ মোল্যার বাড়িতে অবস্থিত রাজাকারদের আস্তানায় নেয়া হয়। সেখানে তাদের তিনদিন আটকে রাখা হয়। রাজাকার কবির মোড়ল প্রতিদিন তাদের সাইকেলের চেইন দিয়ে পেটাত। আতাউর রহমানের পিঠে এখনো সে দাগ রয়েছে। এরপর ইমান আলী বিশ্বাসকে ওয়াপদা ভবনে নিয়ে যায়। এর ৪ দিন পর তারা তাকে ভৈরব নদের পাড়ে নিয়ে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পানিতে পড়ে যান। এরপর তারা তাকে কুপিয়ে জখম করে। এরপরও তিনি বেঁচে ছিলেন। নদের পানিতে ভাসতে- ভাসতে তিনি নওয়াপাড়া পীরবাড়ি খেয়াঘাটে আটকে যান। সেখান থেকে উঠে পাশের একটি সরকারি অফিসের বারান্দায় আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে পরদিন ইমান আলী বিশ্বাসের পিতা নাজের বিশ্বাস সেখান থেকে তাকে এনে যশোর সদর হাসপাতালে ভর্তি করান। এ খবর রাজাকাররা পেয়ে যায়। পরদিন রাজাকার আব্বাস বিশ্বাস ও হাসেম মোল্যা হাসপাতালে গিয়ে ইনজেকশন দিয়ে ইমান আলী বিশ্বাসকে হত্যা করে। ভয়ে সেখান থেকে তার লাশ আনতে কেউ সাহস পায়নি। [মাসুদ আলম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!