You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.25 | ভৈরব রেলব্রিজ অপারেশন (কিশোরগঞ্জ) - সংগ্রামের নোটবুক

ভৈরব রেলব্রিজ অপারেশন (কিশোরগঞ্জ)

ভৈরব রেলব্রিজ অপারেশন (কিশোরগঞ্জ) পরিচালিত হয় ২৫শে অক্টোবর। কিশোরগঞ্জ জেলায় পরিচালিত এ অপারেশনে নেতৃত্ব দেন এ টি এম হায়দার (পাকিস্তান এসএসজি স্পেশাল সার্ভিস কমান্ডো গ্রুপের ক্যাপ্টেন এবং মুক্তিযুদ্ধে ২নং সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক)।
মুক্তিযোদ্ধারা কেবল স্থলপথেই নয়, নৌপথেও বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করেন। এজন্য ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ নামে একটি দুঃসাহসী নৌকমান্ডো গঠন করা হয়েছিল। এ কমান্ডের অধীনে প্রায় তিনশত যুবককে ভারতের ভাগীরথী নদীতে ২ মাস ১০ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণে ভৈরবের কমান্ডার আব্দুর রউফ (পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত একজন চৌকস কমান্ডার ও আগরতলা মামলার অন্যতম অভিযুক্ত), পাকুন্দিয়ার আলাউদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা ও রাজনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা) এবং কিশোরগঞ্জের এ টি এম হায়দার অর্ন্তভুক্ত হয়েছিলেন। এই দুঃসাহসী কমান্ডোরা মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসে হানাদার বাহিনীর নৌ-স্থাপনা ধ্বংসসহ নদীপথে তাদের চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশন চালান। ২৫শে অক্টোবর শেষরাতে ভৈরবে মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত রেলব্রিজ অপারেশন সে-সবের অন্যতম।
ভৈরব ও আশুগঞ্জের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টিকারী ভৈরব রেলব্রিজ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ২য় বৃহত্তম রেলব্রিজ। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বৃহত্তর কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেটের রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ ব্রিজের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ কারণে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে ব্রিজটিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এর উভয় পার্শ্বে রাজাকার ও পাকসেনারা তাদের নজরদারি জোরদার করে। এতদ্সত্ত্বেও বীর মুক্তিযোদ্ধারা দখলদার বাহিনীর যোগাযোগ-ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে ব্রিজটিতে অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু পাকবাহিনীর কঠোর নজরদারিতে স্থলপথে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা এতদিনে সম্ভব হয়নি। অতঃপর সার্বিক দিক বিবেচনা করে এ অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয় পাঁচজন চৌকস নৌকমান্ডোর ওপর। তাঁদের মধ্যে দুজন হলেন এ টি এম হায়দার ও আলাউদ্দিন আহমেদ।
অপারেশনের সময় যাতে মূল ব্রিজটি ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্য অধিনায়ক এ টি এম হায়দার সহযোদ্ধাদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী ব্রিজের পূর্বদিকের রেল লাইন বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়ে ২৫শে অক্টোবর গভীর রাতে কামান্ডোরা খরস্রোতা মেঘনার জলে নেমে পড়েন ৷ অস্ত্র হিসেবে তাঁদের সঙ্গে ছিল এক্সপ্লোসিভ কর্ড, একটি করে চাকু, ৫টি লিম্পেট মাইন এবং জাহাজ বিধ্বংসী শক্তিশালী ম্যাগনেটিক মাইন।
কমান্ডোরা পায়ে ফিন্স লাগিয়ে স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কেটে সন্তর্পণে ব্রিজের দিকে এগিয়ে যান। ব্রিজের কাছাকাছি গিয়ে বিশাল আকৃতির পিলার দেখে প্রথমে তাঁরা একটু ভরকে যান, কিন্তু মনোবল হারাননি। ব্রিজের আশপাশে তখন পাকবাহিনী তীব্র আলো জ্বালিয়ে স্পিডবোটে টইল দিচ্ছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধারা খুব সতর্কতার সঙ্গে ব্রিজের ৩ নম্বর পিলারের চারপাশে এক্সপ্লোসিভ কর্ড পেঁচিয়ে লিম্পেট মাইন যুক্ত করেন। তারপর মাইন থেকে রাবার ক্যাপটি খুলে দিয়ে দ্রুত নদীর স্রোতে গা ভাসিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যান। কিছুক্ষণ পরে বিকট শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হয় এবং দূর থেকে তাঁরা তার শব্দ শুনতে পান। পাকবাহিনীর কঠোর নজরদারি এড়িয়ে নৌকমান্ডোদের ভৈরব রেলব্রিজে সফল অপারেশনের এ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
যুদ্ধের শেষদিকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর আক্রমণে পাকবাহিনী পিছু হটে ভৈরব এসে অবস্থান নেয়। মিত্রবাহিনী যাতে ভৈরবে আসতে না পারে সেজন্য ১০ই ডিসেম্বর তারা শক্তিশালী ডিনামাইট দিয়ে ব্রিজের আশুগঞ্জ অংশের একটি স্প্যান এবং ১৩ই ডিসেম্বর ভৈরব অংশের দুটি স্প্যান উড়িয়ে দেয়। এভাবে পাকবাহিনী ভৈরব বন্দরকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে। [ইমরান হোসাইন]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ৭ম খণ্ড